Translate

১৯৭১ সালে হাওড় অধ্যুষিত ভাটি অঞ্চলের মাকালকান্দি গ্রাম....

হাওড় অধ্যুষিত ভাটি অঞ্চলের মাকালকান্দি গ্রাম ছিল সনাতন ধর্মাবলম্বী কয়েক হাজার লোকের বংশ পরাম্পর বাসস্থান । তৎকালীণ সিলেট জিলার হবিগঞ্জ মহকুমার বানিয়াচং থানাধীন মাকালকান্দি গ্রামের আশেপাশে গ্রামের অধিবাসীরা সকলে সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বী । বর্ষাকালে এসব গ্রাম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দ্বীপের আকার ধারন করে । বর্ষাকালে যোগাযোগ ব্যবস্থার একমাত্র অবলম্বন নৌকা । গোলাভরা ধানের কারনে অর্থনৈতিকভাবে মাকালকান্দি গ্রাম ছিল এসব অন্যান্য গ্রামের মধ্যে বেশ সচ্ছল । মাটির ভালোবাসার টানে ১৯৪৭ এর দেশভাগ কিংবা ১৯৬৫-৬৬ এর পাক্-ভারত যুদ্ধ সময়কার সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত পরিবেশেও এরা দেশত্যাগ করে নি । ১৯৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়েও শহর-গঞ্জ থেকে এতদূরে নিরাপদ থাকা যাবে বলে সবাই মনে করেছিল ।



১৯৭১ সালের ১৭ই আগস্ট রাতে মাকালকান্দি গ্রামের লোকজন তৎকালীণ পাকিস্তান শান্তি কমিটির বানিয়াচং থানা শাখার আহ্বায়ক ও পিডিপি নেতা বানিয়াচংয়ের সৈয়দ ফয়জুল হক মোতওয়াল্লীর সাথে দেখা করে তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা করে । মোতওয়াল্লী তাদের অভয় দিয়ে ফেরৎ পাঠান । পরদিন ১৮ই আগস্ট, বুধবার ছিল বিষহরি পূজা বা মনসা পূজা । পানির দেশ ভাটি অঞ্চলে হিন্দুদের লৌকিক দেবতা সর্পের দেবী বিষহরি পূজা দূর্গাপূজার চেয়েও বড় উৎসব । গরীব-ধনী নির্বিশেষে প্রতি ঘরেই পূজিত হন সর্পদেবী বিষহরি মনসা । স্থানীয় ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী বিষহরি পূজা শেষে সবাই গোলার ধান বিক্রয় করে । এদিকে মোতাওয়াল্লীর অভয় পেয়ে সবাই ১৭ই আগস্ট দিবাগত রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিল । বানিয়াচংয়ের ব্রাহ্মণপাড়াতে হয়েছিল আক্রমণের মূল পরিকল্পনা । অন্যদিকে মোতওয়াল্লীর বাড়ী থেকে মাকালকান্দির লোকজন চলে যাওয়ার পরপরই পুলিশ এসে মোতাওয়াল্লীকে সংবাদ দিয়ে বানিয়াচং থানায় নিয়ে যায় এবং সারা রাত তাকে সেখানে কাটাতেই বাধ্য করে পাক্ মেজর দুররানী ।


১৮ই আগস্ট বিষহরি মনসা পূজার দিনে, ফজরের আজানের আগেই বানিয়াচংয়ের সব রাজাকারদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে পাকিস্তানি সৈন্যরা । রাজাকার আঙ্গুর মিয়ার নেতৃত্বে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় অত্যাধুনিক মার্ক ফোর রাইফেল । বানিয়াচং থানা ঘাটে প্রায় ৩০/৪০টি বড় বড় নৌকা আগেই বাধা ছিল, এর মধ্যে ১৮টি বড় নৌকা ও ১টি পানসীতে করে রওয়ানা হয় পাক্ হানাদারবাহিনী । ভোরের শ্রাবণের চোখে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি । তন্মধ্যে অস্ত্রসমেত রাজাকারদের ভাগ করে বিভিন্ন নৌকায় তোলা হয় । গাইড হিসেবে মোতাওয়াল্লী ও আঙ্গুর মিয়াকে দায়িত্ব দেয়া হল পথ দেখিয়ে নেয়ার । শ্রাবণের অঝোর বৃষ্টির কারনে নৌকা মাঝে মাঝে পথ হারিয়ে ফেলছিল, এজন্য মোতাওয়াল্লীকে বারবার গালাগাল করছিল পাকিস্তানি মেজর দুররানি । বানিয়াচংয়ের বড়বাঁধ এলাকা পাড় হয়ে নৌকা যখন বাগহাতা গ্রাম অতিক্রম করল, তখন সবাইকে অস্ত্র হাতে তৈরী হতে বলল পাকিস্তানি মেজর দুররানী । বাংলার ভাটি অঞ্চলে বর্ষাকালে পানির এমন উত্তাল রূপ দেখে পাকিস্তানিরা বুঝতে পারছিলনা মাকালকান্দি কতদূরে । তাই বেশ দূরে থাকতেই তারা গুলি ছোঁড়া শুরু করে । হাওড়ের মধ্যস্থলে অবস্থিত হওয়ায় মাকালকান্দি গ্রামটি বেশ উচু । ইতিপূর্বে বড় বড় বন্যায়ও গ্রামে পানি উঠেনি । পাকিস্তানিরা এটা জানত না তাই তারা গুলি ছুড়েছিল কিছুটা নিচু হয়ে, গুলি পড়ছিল পানিতে ।


মাকালকান্দি গ্রামের লোকজন খুব ভোরে উঠে ব্যস্ত ছিল বিষহরি মনসা পূজার আয়োজনে । পূর্বপাড়া ও পশ্চিমপাড়া মিলে  মাকালকান্দি গ্রাম, মাঝে শুটা নদী । যেহেতু ব্রাহ্মণপাড়াতেই হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল, তাই ব্রাহ্মণরা সকালবেলা এসে গ্রামের মানুষদেরকে এগুলো জানায় এবং পালিয়ে যাবার পরামর্শ দেয় । তথাপি কেহ ব্রাহ্মণদের কথায় কর্ণপাত না করে হেসে উড়িয়ে দেয় । তাদের যুক্তি ছিল, খান সেনারা ভয়ে পানির দেশে আসবে না । কিন্তু নিজ দেশের রাজাকারেরা এতটুকু ঘৃন্য কাজ করতে পারে, তা তাদের ধারনাই ছিল না । বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাক্ বাহিনীর নৌকাগুলো যখন গ্রামের কাছে আসতে থাকে, তখন গ্রামবাসী ভেবেছিল, হয়ত ধান কেনার নৌকা হবে । কিন্তু পরমুহুর্তেই পাক্ বাহিনীর গুলির শব্দে তারা সম্বিৎ ফিরে পায় ।


স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের অবিরাম আওয়াজ । খানসেনারা প্রথমে উঠে রমেশ চন্দ্র চৌধুরীর বাড়ীতে, প্রথম শহীদ হন গীরিশ চন্দ্র চৌধুরী । গ্রামের লোকজনের মধ্যে হুলস্থুল পড়ে যায় । মাকালকান্দি গ্রামের দক্ষিণ দিক দিয়ে আক্রমন করেছিল হানাদার পাকিস্তানিরা । দক্ষিণের ঢেউয়ে যাতে নৌকার ক্ষতি না হয় সেজন্য গ্রামের নৌকাগুলো উত্তর দিকে বাঁধা ছিল । ফলে যাদের নৌকা ছিল তারা তাড়াতাড়ি নৌকায় উঠে উত্তর দিকে পালাতে শুরু করে । অনেকে প্রাণ রক্ষার্থে পার্শ্ববর্তী শুটা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ।

রাজাকার পরিবেষ্টিত পাক্ সৈন্যরা গ্রামে উঠে নির্বিচারে ‍নিরীহ লোকজনদের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে । তাদের হাত থেকে শিশুরাও বাদ যায় নি । নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে কিছু অসীম সাহসী মানুষ গ্রাম অঞ্চলের দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পাকিস্থানী সৈন্যদের সাথে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হয় । এতে কয়েকজন রাজাকার আহত হয় । কিন্তু পাকিস্থানী সৈন্যদের সংখ্যাধিক্য ও আধুনিক অস্ত্রের মুখে তারা টিকতে পারেনি । সৈন্যরা অস্ত্রের মুখে গ্রামের প্রায় ৫০ জন নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরদের পশ্চিম পাড়ার কর্ণমোহন চৌধুরীর বাড়ীর চন্ডীমন্দিরের সামনে এনে জড়ো করে এবং সেখানেই সবাইকে গুলি করে হত্যা করে । যারা গুলি খেয়েও বেঁচে ছিল তাদেরকে রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় । এরপর তারা আরো অনেককে হত্যা করে ধর্ষণ, লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগে মত্ত হয় । ঘন্টা দু’য়েকের মতো এই পৈশাচিক হামলা অব্যাহত থাকে । এ হামলায় সর্বমোট ৭৯ জন নিরীহ, নিরস্ত্র ও অসহায় লোক প্রাণ হারায় । কর্ণমোহন চৌধুরীসহ তার পরিবারের মোট ৩১জন শহিদ হয় ।



যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে মুজিবকন্যা ও দেশবাসী আজ সোচ্চার । আমরা কি দেখতে পারব বানিয়াচংয়ের সেইসব রাজাকারদের বিচার, যারা ধর্মীয় অনুষ্টানে ঝাপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর ।

তথ্যগুলো মাকালকান্দি গ্রামের সন্তান 'দলছুট' ব্যান্ডের শিল্পী ও সাংবাদিক প্রয়াত সঞ্জীব'দার (সঞ্জীব চৌধুরী) কাছে শোনা । 



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url