Translate

সূক্ষ্ম সনাতন ধর্মের প্রচারক শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর - Bengal Hindu



ছন্দবদ্ধভাবে "হরিচাঁদ ঠাকুরের" জগতে আগমনের হেতু প্রকাশ করেছেন কবি রসরাজ শ্রীতারক চন্দ্র সরকার তাঁর শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত গ্রন্থের আদিখণ্ডের শুরুতেই। অর্থাৎ সূক্ষ্মতম সনাতন ধর্মের প্রচার এবং রক্ষার জন্যেই হরিচাঁদ ঠাকুরের এ জগতে বিশেষ করে বৃহৎ বঙ্গে আগমন।

"মানবকুলে আসিয়ে, যশোমন্ত সুত হয়ে,
জন্ম নিল সফলানগরী।
প্রচারিল গূঢ়গম্য, সূক্ষ্ম সনাতনধর্ম,
জানাইল এ জগত ভরি।।"

শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের (মতান্তরে ১৮১১) খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ এবং ১২১৮ বঙ্গাব্দের ২৯ ফাল্গুন, বুধবার মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দির পার্শ্ববর্তী সফলাডাঙা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম যশোমন্ত ঠাকুর এবং মাতার নাম অন্নপূর্ণা। যশোমন্ত ঠাকুর ছিলেন মৈথিলী ব্রাহ্মণ পরম্পরায় একজন নিষ্ঠাবান কৃষ্ণগতপ্রাণ বৈষ্ণব।

শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত মতের নাম মতুয়া। অর্থাৎ মেতে থাকা। কিসে মেতে থাকা? হরিনামে মেতে থাকা। মতুয়া হলো শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতেরই একটি সহজ-সরল সাধনপথ। শ্রীচৈতন্যেদেবের অযাচিত প্রেম-ভক্তির গঙ্গাধারাকে প্রবহমান করে আরো সহজভাবে সাধারণ কৃষকশ্রেণী বা খেটে খাওয়া মানুষের দ্বারেদ্বারে পৌছে দিতেই বৈষ্ণব মতুয়া মতের আবির্ভাব।শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের মহাজীবন আমাদের সামনে ছন্দবদ্ধভাবে তুলে ধরেছেন কবি রসরাজ শ্রীতারক চন্দ্র সরকার। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনী শ্রীমদ্ভাগবত এবং শ্রীচৈতন্যের দিব্য জীবনী শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতকে অবলম্বনে তিনি হরিলীলামৃত গ্রন্থটি লেখেন।

"শাস্ত্র গ্রন্থ ভাগবত করি সারোদ্ধার।
রচিল তারকচন্দ্র কবি সরকার।।"
(হরি: আদিখণ্ড, প্রথম তরঙ্গ)

কবি রসরাজ শ্রীতারক চন্দ্র সরকারের লেখায় হরিলীলামৃতের শুরুতে আদি খণ্ডতেই আমরা ছন্দবদ্ধভাবে হরিচাঁদ ঠাকুরের দর্শনগত কাঠামোর সন্ধান পাই। তার কিছু দৃষ্টান্ত নিম্নে উল্লেখ করছি।

"কিবা শূদ্র কিবা ন্যাসী যোগী কেন নয়।
যেই জানে কৃষ্ণ তত্ত্ব সেই শ্রেষ্ঠ হয়।।

জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।
এই সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম জানাইতে।
জনম লভিলা যশোমন্তের গৃহেতে।।
মুখে বল হরি হরি হাতে কর কাজ।
হরি বল দিন গেল বলে রসরাজ।।"
(হরি: আদিখণ্ড, প্রথম তরঙ্গ)

যিনি মানুষের মধ্যে কোন জাতিভেদাভেদ করেন না ; জীবের মধ্যে যার দয়ার ভাব প্রবল এবং যিনি সর্বদাই হরিনামে নিষ্ঠার সাথে যুক্ত - তিনিই মতুয়া। অর্থাৎ যিনি সর্বদা 'হাতে কাম, মুখে নাম' করে ভগবানের দিব্যনাম সংকীর্তনে মাতোয়ারা তিনিই 'মতুয়া'। মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ব এবং দেবত্বের ভাব জাগরণেই ছিলো হরিচাঁদ ঠাকুরের ভাব আদর্শের মূলকথা। এ মনুষ্যত্ব এবং দেবত্বের উদ্বোধন আকাঙ্ক্ষায় হরিচাঁদ ঠাকুর আমাদের দিয়েছেন, দ্বাদশ আজ্ঞা। আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক সাধন বিষয়ে দ্বাদশ আজ্ঞার প্রত্যেকটি আজ্ঞা একজন সূক্ষ্ম সনাতন ভাবগ্রাহী মতুয়া সহ সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অবশ্যপালনীয়।

এ দ্বাদশ আজ্ঞা হলো :

১. সদা সত্য কথা বলবে।
২. পিতা-মাতাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করবে।
৩. নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে।
৪. জগৎকে ভালোবাসবে।
৫. সকল ধর্মের প্রতি উদার থাকবে।
৬. পবিত্র চরিত্রের ব্যক্তির প্রতি জাতিভেদ করিবে না।
৭. শ্রীহরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে।
৮. প্রত্যহ প্রার্থনা করবে।
৯. ঈশ্বরে আত্মদান করবে।
১০. বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না।
১১. ষড়রিপু নিজবশে রাখবে।
১২. হাতে কাম ও মুখে নাম করবে।

মনুষ্যত্ব এবং দেবত্বের উদ্বোধনের নির্দেশনা রয়েছে শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞায়। শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর অনুসারীদের যে দ্বাদশ আজ্ঞা প্রধান করেছেন, তা আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক কল্যাণের জন্যে সকলের অবশ্যপালনীয়। এ দ্বাদশ আজ্ঞায় দশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর সদা সত্য কথা বলতে বলেছেন এবং পিতা-মাতাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করতে বলেছেন।বিষয়গুলো বেদেই বলা হয়েছে। বৈদিক এ নির্দেশনাই শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের বাক্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। বৈদিক শিক্ষা সমাপনান্তে বৈদিক সমাবর্তন ভাষণে।বেদাদি শাস্ত্রের সাথে সাথে শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর সহ আমাদের অধিকাংশ মহাপুরুষেরা একই নির্দেশনা বারবার পুনরাবৃত্তি করেছেন।

সত্যং বদ।ধর্মং চর।স্বাধ্যায়ান্মা প্রমদঃ।
সত্যান্ন প্রমদিতব্যম্।ধর্মান্ন প্রমদিতব্যম্।
কুশলান্ন প্রমদিতব্যম্।ভূত্যৈ ন প্রমদিতব্যম্।।
(তৈত্তিরীয়োপনিষদ্ ১.১১.১)

"সর্বদা সত্যকথা বলবে। ধর্মের আচরণ করবে। বেদ অধ্যয়নে কখনো ও অবহেলা করবে না।সত্য থেকে কখনো বিচ্যুত হবে না।

মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেবো ভব।
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ:০১.১১.০২)
" মাতাকে দেবতাজ্ঞান করবে। পিতাকে দেবতাজ্ঞান করবে।"

শুধুমাত্র নমশূদ্র সম্প্রদায় নয় সকল সম্প্রদায়ের মানুষেরা আশ্রয় নিয়েছিলো হরিচাঁদ ঠাকুরের কাছে। তৎকালীন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদের মধ্যে অক্ষয় কুমার চক্রবর্তী, রাধানাথ চক্রবর্তী, জগদীশ চক্রবর্তী, ধীরেন বন্দ্যোপাধ্যায়, পঞ্চানন ভট্টাচার্য, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায় সহ অনেকেই মতুয়া আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। বৈশ্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও অনেকে মতুয়া আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন, এদের মধ্যে মালঞ্চ সাহা ছিলেন অন্যতম ।এছাড়া অন্যান্য ধর্মের অনেক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিই হরিচাঁদ ঠাকুর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, এদের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মীয় যাজক ডা. সি.এস. মিড এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বী তিনকড়ি মিয়া অন্যতম।হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর মানবতাবাদী দিব্যপিযুষ ভাবপ্রবাহ সঞ্চারিত করেন তাঁর সুযোগ্যপুত্র শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুরের মাঝে। গুরুচাঁদ ঠাকুর উপলব্ধি করেন, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং শিক্ষা ছাড়া এ অবহেলিত সম্প্রদায় কখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এ লক্ষ্যে তিনি দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে স্থাপন করেন কয়েক সহস্র পাঠশালা।সত্য, প্রেম এবং পবিত্রতা এই তিনটি মূল স্তম্ভের উপরে মতুয়া মতবাদ প্রতিষ্ঠিত। এ মতবাদে সকল মানুষই সমান। হরিচাঁদ ঠাকুর চেয়েছেন সবাই অকারণ সন্ন্যাসগ্রহণ না করে পরিবার পরিজন নিয়ে গৃহেতে বসেই গৃহের সকল কাজের সাথে সাথে সাধন ভজন করে শ্রীহরির সান্নিধ্য লাভ ।তাই তো তিনি বলেছেন:

"গৃহেতে থাকিয়া যার হয় ভাবোদয়।
সেই যে পরম সাধু জানিও নিশ্চয়।।"

জাতিভেদাভেদ মতুয়াবাদে স্বীকৃত নয়। শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর নিজে তাঁর পিতা যশোমন্ত ঠাকুরের মতো মৈথিলী ব্রাহ্মণ-সন্তান হয়েও সমাজের তথাকথিত নিম্নস্তরের লোকদের ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে তাদের দান করেছেন অনন্য সামাজিক মর্যাদা ; তাইতো দেখা যায়, তাঁর শিষ্যদের সিংহভাগই সমাজের তথাকথিত নিম্নসম্প্রদায়ের মানুষ ।বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া নামধারী গুটিকয়েক নিজেদের অহিন্দু বলে আত্মঘাতী প্রচার করছে, কিন্তু আমি জানি না তারা জানে কিনা শ্রীশ্রীহরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের সময় থেকেই গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি ঠাকুবাড়ির মন্দিরের প্রধান বিগ্রহই হলেন স্বয়ং লক্ষ্মীনারায়ণ। এ লক্ষ্মীনারায়ণ বিগ্রহের পাশেই আছে নিমকাঠের রাধাকৃষ্ণ এবং জগন্নাথ বিগ্রহ। এদের পাশেই আছে পরম ভক্ত ভগবান বিষ্ণুর বাহন গড়ুর পাখি এবং শ্রীহরিচাঁদ-শান্তিমাতা বিগ্রহ। সারাবছর দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা, দোল, জন্মাষ্টমী, রথযাত্রা সহ সকল পূজাপার্বণাদি অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের সাধন এবং আবাসস্থল ওড়াকান্দিতে। তাহলে কিসের ভিত্তিতে এ গুটিকয়েক আত্মঘাতী রাজনৈতিক মতুয়ারা মতুয়াদের সনাতন ধর্ম থেকে আলাদা করতে বিভিন্ন মিথ্যা প্রপাগান্ডা দিনরাত ছড়িয়ে যাচ্ছেন তা আমার ঠিক বোধগম্য নয়।

শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর ১২৮৪ বঙ্গাব্দের ২৩ ফাল্গুন এবং ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের বুধবার তাঁর ইহলীলা সংবরণ করেন। তাঁর জীবন ও আদর্শ নিয়ে কবিয়াল কবি রসরাজ শ্রীতারকচন্দ্র সরকার রচনা করেন শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত নামক বাংলা ভাষায় এক অক্ষয় গ্রন্থ। শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথি মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে বারুণী স্নানের দিনে প্রতিবছর গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে দেশ-বিদেশের লক্ষলক্ষ মতুয়া ভক্তরা সম্মিলিত হয়ে কামনা সাগর নামক এক দিঘিতে স্নান করে শ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের প্রতি তাদের শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করেন।




আমাদের ওয়েবসাইটের পোষ্ট Facebook,MSN বাদে যেকোনো সোসাল মিডিয়ায় শেয়ার ও পোষ্ট করতে পারবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url