দুর্গা প্রতিমা ইচ্ছেমতো তৈরি করা উচিত নয় | Durga Ma | Shri Kushal Baran Chakraborty
দুর্গাপ্রতিমা ইচ্ছেমতো তৈরি করা উচিত নয়। শাস্ত্রে বর্ণিত ধ্যানমন্ত্রের বর্ণনানুসারে দুর্গা প্রতিমা তৈরি করা উচিত। প্রতিমা তৈরি করার সময়ে একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, দেবী প্রতিমাতে যেন জগজ্জননী ভাবটি সন্নিবেশিত থাকে। আধুনিকতার নামে অহেতুক রুচিহীন ও দৃষ্টিকটু প্রতিমা তৈরি করা থেকে বিরত থাকতে হবে।শ্রীদুর্গার স্বরূপ সম্পর্কে বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণের ধ্যানমন্ত্রে বলা হয়েছে:
ॐ জটাজুটসমাযুক্তামৰ্দ্ধেন্দুকৃতশেখরাং ।
অতসীপুষ্পবর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাং।
নবযৌবনসম্পন্নাং সর্ব্বাভরণভূষিতাং॥
সুচারুদশনাং তদ্বৎ পীনোন্নতপয়োধরাং।
ত্রিভঙ্গস্থানসংস্থানাং মহিষাসুরমৰ্দ্দিনীং॥
মৃণালায়তসংস্পর্শ দশবাহুসমন্বিতাং।
ত্রিশূলং দক্ষিণে ধ্যেয়ং খড়গং চক্রং ক্রমাদধঃ॥
তীক্ষ্ণবাণং তথা শক্তিং দক্ষিণেষু বিচিন্তয়েৎ।
খেটকং পূর্ণচাপঞ্চ পাশমঙ্কুশমেব চ।।
ঘন্টাং বা পরশুং বাপি বামতঃ সন্নিবেশয়েৎ।
অধস্তান্মাহিষং তদ্বদ্বিশিরস্কং প্রদর্শয়েৎ॥
শিরচ্ছেদোদ্ভবং তদ্বদ্দানবং খড়গপাণিনং।
হৃদি শূলেন নির্ভিন্নং নির্যদন্ত্রবিভূষিতৎ৷৷
রক্তারক্তীকৃতাঙ্গঞ্চ রক্তবিস্ফুরিতেক্ষণং ।
বেষ্টিতং নাগপাশেন ভৃকুটীভীষণাননং॥
সপাশবামহন্তেন ধৃতকেশঞ্চ দুর্গয়া।
বমদ্রুধিরবক্ত্রঞ্চ দেব্যাঃ সিংহং প্রদর্শয়েৎ।
দেব্যাস্তু দক্ষিণং পাদং সমং সিংহোপরি স্থিতং।
কিঞ্চিদূৰ্দ্ধং তথা বামমঙ্গুষ্ঠং মহিষোপরি।।
প্রসন্নবদনাং দেবীং সর্ব্বকামফলপ্রদাং।
স্তূয়মানং চ তদ্রুপমমরৈঃ সন্নিবেশয়েৎ।।
উগ্রচণ্ডা প্রচণ্ডা চ চণ্ডোগ্রা চণ্ডানায়িকা।
চণ্ডা চণ্ডবতী চৈব চণ্ডারূপাতিচণ্ডিকা।।
অষ্টাভিঃ শক্তিভিস্তাভিঃ সততং পরিবেষ্টিতাং।
চিন্তয়েজ্জগতাং ধাত্রীং ধৰ্ম্মকামার্থমোক্ষদাম্॥
"যাঁর জটাযুক্ত কেশরাশিতে বাঁকাচাঁদ বিরাজিত। যাঁর অপূর্ব সুন্দর ত্রিনয়নযুক্ত মুখমণ্ডল পূর্ণচাঁদের মতো। জগতে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত সেই দেবীর গায়ের রং অতসী ফুলের মতো হলুদ। তিনি নবযৌবনসম্পন্না, সর্বপ্রকার অলংকার দ্বারা সুসজ্জিতা, তাঁর অপূর্ব সুন্দর দন্তরাজি এবং সন্তানকে অমৃতপান করানোর উদ্দেশ্যে তিনি পীনোন্নত-পায়োধরা। মহিষাসুরকে বধের উদ্দেশ্যে তিনি ত্রিভঙ্গরূপে বিরাজিতা। পদ্মের ডাটার ন্যায় বিস্তৃত দশহাতে তিনি দশদিক আলো করে আছেন। এর মধ্যে ডানপাশের হাতে উচ্চ থেকে নিম্ন ক্রমানুসারে তিনি ত্রিশুল, খড়গ, চক্র, তীক্ষ্ণবাণ এবং শক্তি ধারণ করে আছেন। একইভাবে বাম পাশে তিনি ঢাল, ধনুক, নাগপাশ (বন্ধন দড়ি), অঙ্কুশ, ঘন্টা বা কুঠার ধারণ করে আছেন।
দেবীর পদতলে ছিন্ন মস্তক মহিষ এবং সেই মহিষের ছিন্নস্কন্দদেশ থেকে আবির্ভাব হচ্ছে খড়গ হাতে এক ভয়ংকর দানবের। দেবী কর্তৃক নিক্ষিপ্ত ত্রিশুলে সেই দানব মহিষাসুরের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে আছে। তাই রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত দেহে মহিষাসুরের চোখ ক্রোধে রক্তবর্ণ বিস্ফোরিত হয়ে আছে। দেবী ভীষণ নাগপাশ দ্বারা মহিষাসুরকে আবদ্ধ করায় ক্রোধে মহিষাসুর ভ্রূকুটি করে আছে। এতে মহিষাসুরকে আরো ভয়ংকর দেখাচ্ছে। দেবী নাগপাশযুক্ত বাম হাতে মহিষাসুরের চুলের অগ্রভাগ ধারণ করে আছেন। দেবীর পদতলে পাশবদ্ধ মহিষাসুর রক্তবমি করছে। দেবীর ডান পা সিংহের পিঠে এবং বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি একটু উপরে মহিষাসুরের কাঁধে সংস্থাপিত। সকলের আরাধ্য প্রসন্নবদনা এ দেবীই একমাত্র সর্বপ্রকার অভীষ্ট ফলদাত্রী। উগ্রচণ্ডা, প্রচণ্ডা, চণ্ডোগ্রা, চণ্ডানায়িকা, চণ্ডা, চণ্ডবতী, চণ্ডারূপা ও অতিচণ্ডিকা এ অষ্টশক্তি দেবীকে পরিবেষ্টন করে আছেন। ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ এ চতুর্বর্গের প্রদাত্রী জগতের ধাত্রী সেই দুর্গার সদা ধ্যান করি।"
দেবীর ধ্যানমন্ত্রের এ পাঠটিই সর্বাধিক জনপ্রিয়। ধ্যানমন্ত্রের এ জনপ্রিয় পাঠটিই কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে কালিকা পুরাণের ৫৯ অধ্যায়ের ১১-২২ শ্লোকে পাওয়া যায়। কালিকা পুরাণে বলা হয়, আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গার হাতে মহিষাসুর নিহত হলে দেবগণ এই ধ্যানমন্ত্র দ্বারাই দেবীর পূজা করেন এবং দেবীও জগতে মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তিতে বিখ্যাত হন । সেই অবধি জগতে সৰ্বত্র সেই মহিষাসুরমর্দিনী মূর্ত্তিরই পূজা করা হয়। অচিন্ত্য অনন্তরূপা দেবী মহিষমৰ্দ্দিনী মূৰ্ত্তিতেই জগতে প্রসিদ্ধ হন।দেবতাদিগের বরদান হেতু ব্রহ্মাদি সকলেই অচিন্ত্য, ইন্দ্রিয়াতীত দেবীকে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে আরাধনা করেন।
হতে তু মহিষে দেবী পূজিতা ত্ৰিদশৈস্ততঃ ৷
অনেনৈব তু মন্ত্রেণ লোকে খ্যাতিঞ্চ সা গতা ॥
ততঃ প্রভৃতি সা মূৰ্ত্তিঃ সর্বৈঃ সৰ্বত্র পূজ্যতে ।
মূলমূর্তিঃ সুগুপ্তাভূং স্বমূৰ্ত্তা খ্যাতিমাগতা
দেবানাং বরদানেন ব্রহ্মাদৈ রূপযোজনাৎ।
যন্মূত্তিঃ পূজাতে সর্বৈস্তাং মূর্ত্তিং শৃণু ভৈরব ॥
(কালিকা পুরাণ:৫৯.৮-১০)