Translate

শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজা | Durga Puja of Sri Ramachandra

শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজা Durga Puja of Sri Ramachandra,letest writer,letest article

মহর্ষি বাল্মীকি রচিত রামায়ণে রামচন্দ্র কর্তৃক দুর্গাপূজার কথা কোথাও পাওয়া যায় না। কিন্তু একটি শ্লোকে ব্রহ্মার বিধানে শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজা করার ইঙ্গিত রয়েছে। মহর্ষি বাল্মীকি রচিত রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ড বা লঙ্কাকাণ্ডে ব্রহ্মার বিধান দ্বারা রাম লক্ষ্মণের মায়াবী রাক্ষসদের জয় করার কথা বলা আছে।


স সম্প্রাপ্য ধনুষ্মাণির্মাযায়োগমরিন্দমঃ।

তস্থৌ ব্ৰহ্মবিধানেন বিজেতুং রঘুনন্দনঃ৷৷ 

(রামায়ণ: যুদ্ধকাণ্ড, ৮৫.৩৪)

"শত্রুদমনকারী লক্ষ্মণ নিকুম্ভিলা নামক স্থানে উপস্থিত হয়ে ব্রহ্মার বিধান অনুসারে মায়াবী রাক্ষসকে জয় করার জন্য হাতে ধনুক নিয়ে অবস্থান করতে লাগলেন।"


এই শ্লোকে উক্ত ব্রহ্মার বিধান (ব্ৰহ্মবিধানেন)

এবং বিজয় (বিজেতুং রঘুনন্দনঃ) এ দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি বিষয় সর্বজন স্বীকৃত হয়েছে যে, রাবন বধের সকল বিষয়ে ব্রহ্মার বিধান বা নির্দেশনা ছিলো। শ্লোকটিতে সরাসরি হয়ত আদ্যাশক্তি মহামায়ার পূজার প্রসঙ্গ নেই। তবে ব্রহ্মার বিধানে শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজার বিষয়টি অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে রয়েছে মহাভাগবত পুরাণে। মহাভাগবত পুরাণের ৪১ থেকে ৪৮ এই আটটি অধ্যায় ব্রহ্মার বিধান এবং নির্দেশনায় শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজা করার বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজায় স্বয়ং ব্রহ্মা উপস্থিত ছিলেন। মহাভাগবত পুরাণের মত অতটা বিস্তৃতভাবে না হলেও, কালিকা পুরাণসহ অন্যান্য বহু শাস্ত্রে বিষয়টি রয়েছে। তাই শ্রীরামচন্দ্রের  দুর্গাপূজার বিষয়টি বাল্মিকী রামায়ণে নেই বলে, রামের দুর্গাপূজার বিষয়টি এককথায় পরিত্যাগ করা যায় না। 


আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যে কোন কিছুরই আকস্মিক উৎপত্তি ঘটেনি। সকল বিষয়েরই একটি পরম্পরা রয়েছে। সেই পরম্পরাকে অস্বীকার করা এক প্রকারের আত্মঘাতী কর্ম। শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজা সম্পর্কে মহাভাগত পুরাণে বলা হয়েছে, রাক্ষসপতি রাবণ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে অন্য কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি তাঁর মহাবলশালী ভাই কুম্ভকর্ণকে যুদ্ধ করতে জাগ্রত করলেন। কুম্ভকর্ণ পঞ্চ লক্ষ কোটি রাক্ষসসৈন্য নিয়ে যুদ্ধে উদ্যত হলেন। তখন দেবতারা ব্রহ্মার নিকট করে শ্রীরামচন্দ্রকে দৈবী সাহায্য করতে অনুরোধ করলেন। দেবতারা বললেন, কৃম্ভকর্ণ অত্যন্ত মায়াবী এবং যুদ্ধে মহাপরাক্রমশালী; সে পঞ্চলক্ষকোটি ভীমপরাক্রম রাক্ষস সৈন্যে পরিবৃত হয়ে রাম-লক্ষ্মণের সাথে যুদ্ধ করবে। তাই আপনি পৃথিবীতে গিয়ে আপনি শ্রীরামচন্দ্র ও দেবগণের বিজয়লাভার্থ মহাস্বস্ত্যয়ন করে দৈবী সাহায্য করুন।



দেবতাদের প্রার্থনায় ব্রহ্মা ভূতলে শ্রীরামের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। বিবিধ দেবতারাও তাঁর সাথে ভূতলে এলেন। এদিকে সৰ্বলোকেশ্বর মহাবাহু রামচন্দ্র যখন শুনলেন, মহাবল কুম্ভকর্ণ প্রবুদ্ধ হয়ে যুদ্ধার্থ উদ্যত হয়েছে, তখন তিনি লক্ষ্মণ বিভীষণ ও বানরেন্দ্রগণসহ ব্রহ্মাকে অৰ্চনা করলেন। অর্চনাপূৰ্বক শ্রীরামচন্দ্র বললেন, হে সুরজেষ্ঠ আমার মহাভয় উপস্থিত হয়েছে। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে রাবণ এবং তাঁর ভাই কুম্ভকর্ণসহ রাক্ষসপুঙ্গবদের কিভাবে জয় করব?শ্রীরামচন্দ্রের কথায় লোকপিতামহ ব্রহ্মা সৰ্বদেব সমক্ষে শ্রীরামচন্দ্রকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, হে কমলাপতে, তোমার অবিদিত কিছুই নাই। তথাপি হে জগন্নাথ! আপনি ত্রিলোকজননী, ব্রহ্মরূপিণী মহাভয়নিবারিণী, অপরাজিতা, সর্বলোকের জয়কারিণী, সঙ্কটতারিণী কাত্যায়নীই দুর্গার আরাধনা করুন।দেবীর প্রসন্নতা ব্যতীত রাবণাদি মহাবলদিগকে সমরে জয় করতে পারবেন না। আপনি দেবীর আশীর্বাদকে সম্বল করে লঙ্কা জয় করুন। রাবণের পরাজয় করতে এটিই একমাত্র উপায়। আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গা দুষ্টদলের দলনী এবং শিষ্টজনের জয় প্রদায়িনী। তাই সম্প্রতি এই ভয়ংকর যুদ্ধসঙ্কটে তিনিই আপনার একমাত্র স্মরণীয়া এবং পূজনীয়া।


তব নাবিদিতং কিঞ্চিৎ তথাপি কমলাপতে।

যৎপৃচ্ছসি জগন্নাথ জয়ার্থং সমরে শৃণু ॥ 

ত্রৈলোক্যজননী দেবী ব্রহ্মরূপা হি যা পরা। 

কাত্যায়নী তবোপাস্যা মহাভয়নিবারণী।।

জয়দা সর্বলোকানাং যা স্বয়ঞ্চাপরাজিতা। 

তাং প্রার্থয় মহাবাহো দুর্গাং সঙ্কটতারিণীম্ ॥

বিনা প্রসন্নতাং তস্যাঃ সমরে শত্রুসূদন। 

ন বিজেতুং সমর্থোঽসি রাবণাদীন্ মহাবলান্।। 

তাং প্রসাদ্য রঘুশ্রেষ্ঠ জয় লঙ্কাং মহামতে। 

এষ এব হুপায়ো ত্র দৃশ্যতে স্য পরাজয়ে।।

 দুষ্টপ্রমৰ্দ্দিনী সৈবং সতামপি জয়প্রদা।

স্মর্ভব্যা পূজিতব্যা চ সাম্প্রতং সা ত্বয়া ধ্রুবম্।। 

(মহাভাগবত পুরাণ: ৪১, ২৩-২৬, ২৮-২৯)


এরপরে পিতামহ ব্রহ্মা শ্রীরামচন্দ্রকে পবিত্র  হয়ে একাগ্রতায় সাথে দেবীকে ভক্তিভরে স্তব এবং পূজা করার নির্দেশনা প্রদান করেন। পিতামহ ব্রহ্মা শ্রীরামচন্দ্রকে প্রথমে দেবীর বোধন সম্পন্ন করতে সমুদ্রের উত্তর তটে দেবতাদেরকে সাথে নিয়ে বিল্ববৃক্ষে দেবীকে আহ্বান করলেন। ব্রহ্মার নির্দেশনায় শ্রীরামচন্দ্র হাতজোর করে উত্তরমুখি হয়ে যুদ্ধে জয় লাভের জন্য একাগ্র হৃদয়ে জয়দাত্রী দেবী জগদম্বার স্তুতি করতে লাগলেন।


তাবৎ প্রপূজয়িষ্য মি যুদ্ধে তে জয়কাম্যয়া।

তন্তু রাম শুচীর্ভূত্বা স্তুত্বা দেবীং সমাহিতঃ ।।

যুধ্যস্ব রাক্ষসৈঃ সার্দ্ধ প্রাপ্সসি রাঘব ।

প্রবুদ্ধায়ান্তু দব্যাং বৈ সংগ্রামাবসরে স্বয়ম্।।

গত্বা গত্বা ভগবতীং প্রার্থয়িষ্যসি রাঘব।।

শ্রীমহাদেব উবাচ।

এবমুক্তঃ স ভগবান্‌ দেব্যাঃ সম্বোধনায় বৈ ।

সমুদ্রস্যোত্তরে তীরে বিল্ববৃক্ষস্য সন্নিধিম্‌ ।।

প্রযযৌ ত্রিদশৈঃ সার্দ্ধং সর্বলোকপিতামহঃ।

রামস্তু প্রাঞ্জলির্ভূত্বা চেত্তারাভিমুখস্ততঃ ।

তুষ্ট্বাব জয়লাভায় সংগ্রামে জয়দায়িনীম্‌ ।।  

(মহাভাগবত পুরাণ:৪৩.৯২-৯৭)


"ব্রহ্মা বলন হে রাঘব! তুমি শুচি হয়ে সমাহিত মনে দেবীকে ভক্তিভরে স্তব পূজা করে, রাক্ষসদের সাথে যুদ্ধ কর তবেই তোমার জয় লাভ হবে। দেবী প্রবুদ্ধ হলে সংগ্রামকালে তুমি যখন অবসর পাবে, তখন একবার ভক্তিভরে ভগবতী দুর্গার নিকট প্রার্থনা করবে।শ্রীমহাদেব বললেন, সর্বলোকের পিতামহ ভগবান ব্রহ্মা দেবীর বোধনের প্রসঙ্গে রামকে নির্দেশনা দিয়ে তাঁকে নিয়ে সমুদ্রের উত্তর তটে অন্যসকলকে সাথে নিয়ে বিল্ববৃক্ষের নিকট গমন করলেন। রামচন্দ্রও হাতজোর করে উত্তরমুখি হয়ে যুদ্ধে জয় লাভের জন্য জয়দাত্রী দেবী জগদম্বার স্তুতি করতে লাগলেন।


নমস্তে ত্রিজগদ্বন্দে সংগ্রামে জয়দায়িনি ।

প্রসীদ বিজয়ং দেহি কাত্যায়নী নমোঽস্তু তে ।।

সর্বশক্তিময়ে দুষ্টশক্তিমর্দনকারিণি।

দুষ্টজৃম্ভিণি সংগ্রামে জয়ং দেহি নমোঽস্তু তে ।।

ত্বমেকা পরমা শক্তিঃ সর্বভূতেষ্ববস্থিতা ।

দুষ্টসংহর্ত্রি সংগ্রামে জয়ং দেহি নমোঽস্তু তে ।।

রণপ্রিয়ে রক্তভক্ষে মাংসভক্ষণকারিণি ।

প্রপন্নার্ত্তিহরে যুদ্ধ্বে জয়ং দেহি নমোঽস্তু তে ।।

খট্বাঙ্গাসিকরে মুণ্ডমালাদ্যোতিতবিগ্রহে। 

অসূরাসৃকপ্রিয়া নিত্যং জয়ং দেহি নমোঽস্তু তে।।

সিংহবাহিনী গৌরাঙ্গি প্রসন্নমূখপঙ্কজে।

ত্রিশুলধারিণি রণে জয়ং দেহি নমোঽস্তু তে।।

(মহাভাগবত পুরাণ: ৪৪, ১-৬)


"শ্রীরাম বললেন, হে ত্রিলোকবন্দনীয়া । যুদ্ধে বিজয় দানকারিণী ! হে কাত্যায়নী তোমাকে বারবার প্রনাম করি; তুমি প্রসন্না হয়ে আমাকে বিজয় দান কর। হে সর্বশক্তিময়ী , শক্তিদ্বারা দুষ্ট অসুরদের নিগ্রহকারিণী, দুষ্টের সংহারিনী ভগবতী ! যুদ্ধে আমাকে জয় দাও। তোমাকে প্রণাম। হে রণপ্রিয়ে ! হে অসুরের রক্তমাংসভক্ষণকারিণী দেবী! হে শরণাগতের রক্ষাকারিণী দেবী , আমাকে যুদ্ধে বিজয় প্রদান কর। তোমাকে প্রণাম। তোমার হাতে খড়্গখটাঙ্গ, অঙ্গ তোমার মুণ্ডমালায় বিভূষিত। তুমি আমায় যুদ্ধে জয় দাও, তোমাকে প্রণাম। হে গৌরাঙ্গী! তুমি সিংহবাহিণী, তোমার মুখপদ্ম নিত্য প্রসন্ন।হে ত্রিশুলধারিণী! আমাকে যুদ্ধে বিজয় প্রদান কর। তোমাকে প্রণাম।"


দুর্গাপূজা বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায় কৃত্তিবাস ওঝার (আনু. ১৩৮১-১৪৬১) লেখা কৃত্তিবাসী বাংলা রামায়ণে। এই রামায়ণটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম গ্রন্থ। বাঙালি ধর্ম, সমাজ এবং সংস্কৃতির সাথে এই গ্রন্থটির সম্পর্ক  অবিচ্ছেদ্য। 



রাবন বধ প্রসঙ্গে ব্রহ্মার বিধান প্রসঙ্গে কৃত্তিবাস তাঁর কৃত্তিবাসী রামায়ণে লিখেছেন:

“শুনিয়া ইন্দ্রের বাণী, কন কমণ্ডুলু-পাণি, 

উপায় কেবল দেবীপূজা।

তুমি পূজি যে চরণ, জিনিলে অসুর-গণ, 

বোধিয়া শরতে দশভুজা ৷৷

রাম কৈলে পূজা তার, হবে রাবণ-সংহার, 

শুন সার সহস্র-লোচন।

শুনি কহে সুরপতি, যাহ তুমি শীঘ্রগতি, 

জানাও শ্রীরামে বিবরণ।

প্রেমে পুলকিত-চিত, পদ্মযোনি আনন্দিত,

 শ্রীরাম নিকটে উপনীত।

 বিনয় করিয়া কয়, শুন প্রভু দয়াময়,

রাবণ-বধের যে বিহিত ৷৷ 

ব্রহ্মার বচন শুনি, কন রাম গুণমণি, 

কহ বিধি কি উপায় করি।

মিথ্যা শ্রম করিলাম, অনুপায়ে ঠেকিলাম, 

রক্ষিল রাবণে মহেশ্বরী৷৷

বিধাতা কহেন প্রভু, এক কর্ম্ম কর বিভু,

তবে হবে রাবণ-সংহার।

অকালে বোধন করি, পুজ দেবী মহেশ্বরী

তরিবে হে এ দুঃখ-পাথার ৷৷"



কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url