মিয়ানমারে হিন্দুগণ (ভূমিকা) | Hindus in Myanmar (Introduction)
লেখকঃ Dolon Chapa
মিয়ানমার (বর্মা) এর সঙ্গে হিন্দুদের পরিচয় সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই। হিন্দু বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে একে ব্রহ্মদেশ নামে উল্লেখ আছে। ব্রহ্মদেশ নামটিও এসেছে ব্রহ্মার (তিন প্রধান দেবতার একজন) নামানুসারে। এক সময় হিন্দু রাজ্য যে ব্রহ্মদেশ, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম হয়ে সেই ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিসৃত ছিল, তাহা হয়তো আপনাদের সকলেরই জানা। পরে বৌদ্ধ থেরবাদ ব্যপক ভাবে প্রসার পায় এই অঞ্চলে।
১৩ শতকের দিকে মিয়ানমারে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন রাজ্য সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আজকের আরাকান রাজ্য (বর্তমান নাম রাখাইন)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত (১৮৮৫-১৯৪৮) মিয়ানমার ছিল ইংরেজদের শাসনের অধীনে। এই সময়ে ইংরেজরা খনি, কাঠ সহ বিভিন্ন খাতে কাজ করানোর জন্য দশ লক্ষেরও বেশি ভারতীয়দের নিয়ে আসে। এদের বড় অংশই ছিল তামিল বা বাঙালি বংশোদ্ভূত। এছাড়াও আছে নেপালি গুর্খা জাতির হিন্দু। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসেও আমরা দেখতে পাই, নায়ক শ্রীকান্ত স্টীমারে চেপে কাজের উদ্দেশ্যে রেঙ্গুনে যাচ্ছে। ১৯৩১ সালের তথ্য বলছে, রেঙ্গুনের (Yangon) ৫৫% জনসংখ্যাই ছিল ভারতীয় । সেই সময়ে রেঙ্গুন (নিচের ছবি) ছিল অত্র অঞ্চলের অন্যতম গুরুতবপূর্ণ নৌবন্দর এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র।
এখানে বলে রাখি, শ্রীলঙ্কাতেও ইংরেজরা সেই একই কাজ করেছিল, তামিলদের চা বাগানে কাজ করার জন্য নিয়ে গিয়েছিল। সেই তামিল-সিংহলি সংঘাত আজও চলে আসছে। লক্ষ-লক্ষ হিন্দুর রক্ত ঝরছে।
তথ্য ১ঃ রেঙ্গুনের অবস্থান
স্বাধীনতা লাভের পরে ১৯৪৮ সালে নাগরিক আইন পাশ করে মিয়ানমার সরকার; এক্ষেত্রে বিদেশীদের (বা বিদেশী বংশোদ্ভূতদের) মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ রোহিত হয়। ১৯৬৩-১৯৬৭ সালের মধ্যে প্রায় ৩ লক্ষ ভারতীয় এবং ১ লক্ষ চীনাদের resident aliens দেখিয়ে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয় এবং তাদের সম্পত্তি জব্দ করা হয়। ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইন পুর্নোবিবেচনা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এই আইনেরও বহু জটিলতা রয়েই গেছে। যদিও এই আইনের ফলে হিন্দুরা ভোটাধিকার পেয়ে যায়, তবুও কিছু কিছু রাজ্যে, যেমন রাখাইন হিন্দুদের ভারতীয় হিসেবে বিবেচনা করে স্পেশাল কার্ড দেয়া হয়ে থাকে।
তথ্য ২ঃ মিয়ানমারের আদমশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যার তুলনা
ওপরের উপাত্তে বিভিন্ন আদমশুমারির সময় হিন্দু জনসংখ্যার হ্রাস-বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। লক্ষ্যকরলে দেখবেন ১৯৭৩ সালে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধি না পেয়ে ঋণাত্মক হয়ে গিয়েছিল। ইহা সেই নাগরিক ১৯৪৮ সালের নাগরিক আইনের দরুন।
Pew Research এর তথ্য অনুসারে ২০১০ সালে মিয়ানমারে প্রায় ৯ লক্ষ হিন্দুদের বসবাস যা মোট জনসংখ্যার ১.৭%। এদের মধ্যে বড় অংশেরই বসবাস বাগো (Bago), মন(Mon), রেঙ্গুন (Yangon), এবং মান্দালাই (Mandalay) অঞ্চলে। নিচের ছবিতে এদের অবস্থান দেয়া হইল।
ইহা ছাড়াও অন্যান্য রাজ্যেও কম-বেশী হিন্দুদের বসবাস আছে। ২০১৪ সালের আদমশুমারি অনুসারে প্রায় ৫ হাজার (০.৫%) হিন্দুদের বসবাস রাখাইন রাজ্যের মাউংদাউ জেলায়। এখানে বলে রাখা ভাল, মিয়ানমারে বৌদ্ধ ধর্ম প্রায় ৮৮% যেখানে রাখাইন রাজ্যে ৬৪% এবং মুসলিম ৩৫.১%। এই তথ্য খুব ভাল করে মাথায় ঢুকিয়ে রাখুন। কারণ ১২টি রাজ্য নিয়ে গঠিত মিয়ানমারের কোথাও ধর্ম নিয়ে কোন সমস্যা না থাকলেও এই রাজ্যে যে গত কয়েক যুগ ধরে রোহিঙ্গা সমস্যা চলে আসছে তা বুঝতে আপনাদের সহায়তা করবে।
২৫ আগস্ট ২০১৭ এই রাখাইন রাজ্যের উত্তর-মাউংদাউ (Maungdaw) জেলার খা মাউং সেক (Kha Maung Seik) গ্রাম মুসলমান আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (Arakan Rohingya Salvation Army-ARSA) হাতে কিভাবে শতাধিক হিন্দু হত্যা, ধর্ষিত হয়েছিল তাহাই আমি পরবর্তী পর্বে বর্ণনা করিব।