বিজ্ঞান-বিক্রমের যশেই মানুষ অমর হয় | Shri Kushal Baran Chakraborty
সামবেদের ছান্দোগ্য উপনিষদে নারদ এবং সনৎকুমার সংবাদে ধ্যান অপেক্ষা বিজ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ বলে অবিহিত করা হয়েছে। এরপরে বিজ্ঞানের মাধ্যমে কি কি জানা যায়; সেই অতুল্য জ্ঞানরাশির একটি দীর্ঘ তালিকা প্রদান করা হয়েছে।
সে তালিকাটি হল:
বিজ্ঞানং বাব ধ্যানাদ্ভূয়ো বিজ্ঞানেন বা ঋগ্বেদং বিজানাতি যজুর্বেদং সামবেদমাথবর্ণং চতুর্থমিতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদানাং বেদং পিত্র্যং রাশিং দৈবং নিধিং বাকোবাক্যমেকায়নং দেববিদ্যাং ব্রহ্মবিদ্যাং ভূতবিদ্যাং ক্ষত্রবিদ্যাং নক্ষত্রবিদ্যাং সর্পদেবজনবিদ্যাং দিবং চ পৃথিবীং চ বায়ুং চাকাশং চাপশ্চ তেজশ্চ দেবাংশ্চ মনুষ্যাংশ্চ পশৃংশ্চ বয়াংসি চ তৃণবনস্পতীঞ্ছ্বাপদান্যাকীট- পতঙ্গপিপীলকং ধর্মং চাধর্মং চ সত্যং চানৃতং চ সাধু চাসাধু চ হৃদয়জ্ঞং চাহৃদয়জ্ঞং চান্নং চ রসং চেমং চ লোকমমুং চ বিজ্ঞানেনৈব বিজানাতি বিজ্ঞানমুপাস্ স্বেতি।।
(ছান্দোগ্য উপনিষদ:৭.৭.১)
"ধ্যান অপেক্ষা বিজ্ঞান শ্রেষ্ঠ। ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, চতুর্থস্থানীয় অথর্ববেদ, পঞ্চম স্থানীয় ইতিহাস-পুরাণ, ব্যাকরণ, শ্রাদ্ধবিষয়ক তত্ত্ব, গণিতশাস্ত্র, দৈব উৎপাতসমূহের বিদ্যা, খনিজসম্পদ সংক্রান্ত বিদ্যা, তর্কশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র, জ্যোতিষবিদ্যা, ব্রহ্মবিদ্যা, ভূ-তত্ত্ব বিদ্যা, ধনুর্বেদ, জ্যোতির্বিদ্যা, সর্পবিদ্যা, নৃত্য গীতাদি কলাবিদ্যা, স্বর্গ, পৃথিবী, আকাশ, বায়ু, জল, অগ্নি, দেবতাসমূহ, মনুষ্যগণ, পশুসমূহ, পাখিরা, তৃণ ও বনস্পতি সমূহ, শ্বাপদ, কীট-পতঙ্গ ও পিঁপড়ে পর্যন্ত (সমস্ত প্রাণী); ধর্ম ও অধর্ম, সত্য ও অসত্য, শুভ ও অশুভ, প্রীতিকর ও অপ্রীতিকর, অন্ন ও রস, ইহলোক ও পরলোক –(এ সবই) বিজ্ঞানের দ্বারা জানা যায়। তাই বিজ্ঞানের উপাসনা কর।"
পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থে এভাবে সুস্পষ্টভাবে বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়নি। তাই আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক বিষয় আজও আমরা সুস্পষ্টভাবে বেদের মধ্যে, বিভিন্ন পুরাণের মধ্যে দেখি। পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন ব্যাকরণ 'অষ্টাধ্যায়ী' রচনা করেছেন পাণিনি মুনি। পৃথিবীর প্রাচীনতম ধ্বনিতত্ত্বের গ্রন্থ ঋগ্বেদীয় 'শৌণকীয় প্রাতিশাখ্য'। সর্বপ্রাচীন চিকিৎসা বিদ্যার গ্রন্থ 'চরকসংহিতা'। সর্বপ্রাচীন শল্যচিকিৎসার গ্রন্থ 'সুশ্রুতসংহিতা'। কিন্তু বর্তমানে ইউরোপীয়দের প্রচারণায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিসেবে 'হিপোক্রেটিক কর্পাস' এর রচয়িতা গ্রিক চিকিৎসাবিদ হিপোক্রেটিসকে ( আনু. খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০- খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০) বলা হয় । সর্বপ্রাচীন পশু চিকিৎসকের নাম শালিহোত্র, তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম 'শালিহোত্র সংহিতা'। গণিতশাস্ত্র আর জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা করেছেন আর্যভট্ট।উচ্চমানের বীজগণিতের (অ্যালজেবরা) চর্চা করেছেন ভাস্করাচার্য।শ্রীমদ্ভাগবত পরবর্তীতে পারমাণবিক তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করেছেন দার্শনিক কণাদ।রাসায়নিক বিজ্ঞানে অতুলনীয় অবদান রেখে রসায়ন গ্রন্থ রচনা করেছেন নাগার্জুন। সুস্থ থাকতে আধুনিক যোগের প্রবর্তন করেছেন ঋষি পতঞ্জলি।ব্যোমযান বা বৈমানীয় প্রযুক্তিবিদ্যার প্রবর্তন করেন ঋষি ভরদ্বাজ। এছাড়া কপিল, ব্রহ্মগুপ্ত বরাহ মিহির সহ অসংখ্য বিজ্ঞান সাধকের নাম এবং তাঁদের অতুলনীয় অবদানের কথা বলা যায়। পুরাণে কিছু আপাতদৃষ্ট অলৌকিকতা, অতিবাস্তবতা রয়েছে। তবে এরপরেও পুরাণের মধ্যে অনেক আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিহিত রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শ্রীমদ্ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে কপিল ঋষির দেয়া পরমাণুর সংজ্ঞার কথা। এ সংজ্ঞার সাথে আধুনিক পরমাণুর সংজ্ঞার পার্থক্য মাত্র উনিশ-বিশ। শ্রীমদ্ভাগবতের শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছে, পরমাণু দ্বারা মহাবিশ্ব গঠিত যা কোয়ান্টাম তত্ত্বে বলা হয়েছে।
চরমঃ সদ্বিশেষাণামনেকোহসংযুতঃ সদা।
পরমাণুঃ স বিজ্ঞেয়ো নৃণামৈক্যভ্রমো যতঃ।।
সত এব পদার্থস্য স্বরূপাবস্থিতস্য যৎ।
কৈবল্যং পরমমহানবিশেষো নিরন্তর।।
( শ্রীমদ্ভাগবত: ৩.১১.১-২)
"জড় জগতের যে ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য অংশ এবং দেহরূপে যার গঠন হয় না, তাকে বলা হয় পরমাণু। সর্বদা সে অদৃশ্য অস্তিত্ব নিয়ে বিদ্যমান থাকে, এমনকি প্রলয়ের পরেও। পরমাণু হচ্ছে ব্যক্ত জগতের চরম অবস্থা। যখন তারা বিভিন্ন প্রকারের শরীর নির্মাণ না করে তাদের স্বরূপে স্থিত থাকে, তখন তাদেরকে বলা হয় পরম মহৎ। ভৌতিক রূপে নিশ্চয়ই অনেক প্রকারের শরীর রয়েছে, কিন্তু পরমাণুর দ্বারা সমগ্র জগৎ সৃষ্টি হয়।"
গরুড় পুরাণে বলা হয়েছে, যে সকল মানুষেরা কেবল নিজের উদরমাত্র পরিপোষণ করে নিজেকেই নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সে মনুষ্য মনুষ্যই নয়। জগতের কল্যাণে বিজ্ঞান, বিক্রম ও যশের দ্বারা সমৃদ্ধ হতে বলা হয়েছে।
সজ্জীবিতং ক্ষণমপি প্রথিতং মনুষ্যৈ
বিজ্ঞান-বিক্রম-যশোভিরভগ্নমানৈঃ।
তন্নাম জীবিতমিতি প্রবদন্তি তজ্জ্ঞাঃ
কাকোঽপি জীবতি চিরঞ্চ বলিঞ্চ ভূঙক্তে।।
(গরুড়পুরাণ: পূর্বখণ্ড, ১১৫ অধ্যায়,৩৩)
"যারা বিজ্ঞান বিক্রম ও যশের দ্বারা প্রখ্যাত হয়েছে, তারাই ধন্য। পক্ষান্তরে যে মনুষ্য কেবল নিজের উদরমাত্র পরিপোষণ করে নিজেকেই নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সে মনুষ্য মনুষ্যই নয়। কাকও বলিরূপ অন্যের দেয়া খাবার খেয়ে জীবিত থাকে।"
যখন পৃথিবীর কয়েকটি পশ্চিমা জাতি দেশ জয় করে জোর পূর্বক ধর্মান্তরিত করেছে। জোর পূর্বক বিজিত রাজ্যে নিজের ধর্ম সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়েছে। জোর পূর্বক নিজেদের ভাষা চাপিয়ে সেই ভূখণ্ডের প্রাচীন ভাষা এবং সংস্কৃতিতে মুছে দিয়েছে। ঠিক সে সময়ে ভারতবর্ষের মানুষ বিজ্ঞানচর্চা করে জগতের কল্যাণ করেছে। জগতের প্রত্যেকটি জীবের শান্তি কামনা করেছে। তারা বিজ্ঞান, বিক্রম ও যশের দ্বারা সমৃদ্ধ হতে চেয়েছে। বর্বর আরবীয়, তুর্কি সাম্রাজ্যবাদীসহ অনেকটা সভ্য ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা শত প্রচেষ্টা করেও এই ভূখণ্ডের শাশ্বত হিন্দু সংস্কৃতিতে বিধ্বংস করতে পারেনি। তাই আজও স্বমহিমায় হিন্দু জাতি বিজ্ঞান, বিক্রম ও যশের সাধনায় রত। এ সাধনাই তাদের অমর করেছে।