Translate

শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গােস্বামী || সংক্ষিপ্ত গল্প

বাংলা ১২৪৮ সালের (১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দ) শ্রাবণ মাস। তখন ছিল পূর্ণিমা তিথি। 


নবদ্বীপের শান্তিপুরে প্রতি বৈষ্ণব মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের ঝুলন যাত্রা উৎসব পালিত হচ্ছে। সেই উৎসবমুখর পুণ্য তিথিতে ভাের বেলায় বিজয়কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন । পিতা আনন্দকিশাের গােস্বামী ছিলেন পরম নিষ্ঠাবান ভক্ । মা স্বর্ণময়ী দেবীও ছিলেন একজন ধর্মনিষ্ঠ দয়াবতী রমণী। বিজয়কৃষ্ণ গ্রামের পাঠশালায় শিক্ষাজবন শুরু করেন। তারপর ভর্তি হন শান্তিপুর টোলে। সেখানের পড়া শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন কোলকাতার সংস্কৃত কলেজে। এ-সময় তাঁর বিয়ে হয়। স্ত্রী যােগমায়া ছিলেন শিকারপুরের রামচন্দ্র ভাদুড়ীর কন্যা। সংস্কৃত কলেজে কিছুকাল পড়ার পর বিজয়কৃষ্ণ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। 

সেখানে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে হিতসঞ্চারিণী' নামে এক সভা স্থাপন করেন। সভার সিদ্ধান্ত ছিল: যিনি যা সত্য বলে বুঝবেন, তিনি তা প্রাণপণে কার্যে পরিণত করবেন। এই সভায় বিজয়কৃষ্ণ এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, পৈতা জাতিভেদের চিহ্ন। তাই আমাদের পৈতা ত্যাগ করা উচিত। এ-কথা শুনে যারা ব্রাহ্মণ ছিলেন তাঁরা সবাই পৈতা ফেলে দেন। সেই সময়ে ব্রাহ্মণ হয়ে পৈতা ফেলে দেয়া এক দুঃসাহসিক কাজ ছিল। এই সময় ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে বিজয়কৃষ্ণের যােগাযােগ ঘটে। 


মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্রের বক্তৃতা শুনে তার মনে পরিবর্তন আসে। তিনি ব্রাহ্মধর্মের প্রতি অনুরক্ত হন এবং ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। বিজয়কৃষ্ণের এই পৈতা বর্জন ও ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা ভালাে চোখে দেখেন নি। বিজয়কৃষ্ণ এ-সময় শান্তিপুরে এলে তাঁর প্রতি তাঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বিজয়কৃষ্ণও তাঁর মত ও বিশ্বাসের ব্যাপারে আপােষ করেন নি। তিনি কোলকাতা চলে আসেন। তখন বিজয়কৃষ্ণের মেডিকেলের চূড়ান্ত পরীক্ষা সামনে। তিনি প্রস্তুত হচ্ছেন। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজ থেকে ডাক এল ধর্ম প্রচারের। চিকিৎসক জীবনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে বিজয়কৃষ্ণ ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি হলেন ব্রাহ্মসমাজের আচার্য বিজয়কৃষ্ণ। ঢাকা, বরিশাল, যশাের, খুলনা এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করেন। অনেককে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাও দেন। বিজয়কৃষ্ণ এক সময় উত্তরাস্থলে অবস্থান করছিলেন। তখন তিনি এক কঠিন অসুখে পড়েন । সেবার বারদীর শ্রীলােকনাথ ব্রহ্মচারীর কৃপায় তিনি সুস্থ হন। এ ঘটনা তাঁর জীবনে এক গভীর প্রভাব ফেলে। বাবা লােকনাথ এবং ঠাকুর রামকৃষ্ণের প্রভাবে তার মধ্যে আবার বৈষ্ণব ভাব জেগে ওঠে। এ-সময় গয়ার আকাশ গঙ্গা পাহাড়ে তাঁর সাক্ষাৎ হয় যােগী ব্রহ্মানন্দ স্বামীর সঙ্গে। তিনি তাঁকে দীক্ষা দিয়ে পুনরায় হিন্দু যােগীতে পরিণত করেন। এরপর বিজয়কৃষ্ণ ব্রাহ্মধর্ম ছেড়ে দেন। এ-সময় বিজয়কৃষ্ণ স্ত্রী, পুত্র-কন্যা এবং শিষ্যদের নিয়ে ভীষণ অর্থকষ্টে পড়েন। তখন লােকনাথ বাবার নির্দেশে তিনি ঢাকার গেন্ডারিয়ায় আশ্রম স্থাপন করে নামগান ও হরিসংকীর্তন করতে থাকেন। এতে তাঁর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং ঢাকায় তাঁর যশ-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। 

বিজয়কৃষ্ণ ঢাকায় আশ্রম স্থাপন করলেও মাঝে মাঝেই তনি কোলকাতা যেতেন। একবার স্ত্রীকে নিয়ে তিনি বৃন্দাবনে যান। সেখানে কলেরা রােগে স্ত্রীর মৃত্যু হয়। তারপর ১৩০৪ সালের (১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দ) ফাল্গুন মাসে বিজয়কৃষ্ণ শ্রীক্ষেত্র পুরী চলে যান। সেখানে অতি অল্প সময়েই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। উড়িষ্যা প্রদেশেও তাঁর প্রভাব ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে স্থানীয় ধর্মব্যবসায়ীরা একদিন তাঁকে বিষ মিশ্রিত লাড়ু খেতে দেয়। তাতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৩০৬ সালের (১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ) ২২এ জ্যৈষ্ঠ রবিবার ইহলােক ত্যাগ করেন।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url