সাম্প্রদায়িক বঙ্কিমচন্দ্র : একটি বামৈস্লামিক প্রোপাগান্ডা
সুনীল আরও লিখেছেন , " ' বন্দেমাতরম' গানটির প্রথমাংশ দেশবন্দনার কাব্য হিসেবে অতি উচ্চাঙ্গের। 'বন্দেমাতরম' এই ধ্বনিও জাতীয়তাবোধ জাগাবার পক্ষে আদর্শস্থানীয় হতে পারতো। দেশকে জননী বলা ভারতীয় ঐতিহ্যের অনুযায়ী এবং মু.সল.মানদের এটা মেনে না নেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। এবং মু.সল.মানেরা শুধু দেশকে জননী রূপে দেখার কারণেই ' বন্দেমাতর ম' কে বর্জন করলে সেটা তাদের নিকৃষ্ট গোঁড়ামি বলে আমরা ধিক্কার দিতে পারতাম অনায়াসেই। কিন্তু ক্রমশঃ এই দেশজননীর রূপকল্পনা রূপান্তরিত হয়েছে সম্পূর্ণ এক হিন্দু দেবীর মূর্তিতে, মু.সল.মানেরা সেই দেবীমূর্তির বন্দনা করতে কেন বাধ্য হবে? এবং এই বন্দেমাতরম গানটি রয়েছে এমন একটি গ্রন্থে, যে গ্রন্থের মূল বক্তব্যই হলো মু.সল.মানেরা হি.ন্দু.দের শত্রু। ইংরেজ বন্ধু কিন্তু মু.সল.মান শত্রু। " শুধু এখানেই না থেমে সুনীল বঙ্কিমের প্রতি অনুযোগ করেছেন, " বঙ্কিম তাঁর উপন্যাসগুলিতে অনবরত চেষ্টা করেছেন হি.ন্দু মু.সল.মানের বিভেদ সৃষ্টির। বাঙালি জাতি ও তাঁর মাতৃভূমিকে দ্বিখন্ড করার জন্য কাঁঠালপাড়া নিবাসী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কি কিছুটা পরিমাণে দায়ী নন? "
সুনীলের এই সমালোচনা যেন মুজফফর আহমেদের বক্তব্যে প্রতিধ্বনি শোনা যায় :
মুজফফর আহমেদ " সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের অভুদ্যয় " প্রবন্ধে লিখেছেন, "বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “ আনন্দ মঠ ” হতে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীরা প্রেরণা লাভ করতেন। এই পুস্তকখানি শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। এর মূল মন্ত্র ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ বন্দেমাতরম ’ গান।
তাতে আছে-
বাহুতে তুমি মা শক্তি
হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি
তোমার প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।
ত্বংহি দুর্গা দশপ্রহরণ ধারিণী ইত্যাদি।
একেশ্বরবাদী কোনও মু.স.লিম ছেলে কি করে এই মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারত? "
সত্তরের দশকে প্রবন্ধটি লেখাকালীন সুনীল হয়তো সৈয়দ আহমেদ খানের কথা বিস্মৃত হয়েছিলেন। যদুনাথ সরকার বা রেজাউল করিমের বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে মূল্যয়ন সনাতন পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল, এটা মেনে নেওয়া বড় শক্ত। দেখা যাক যদুনাথ সরকার বা রেজাউল করিম বঙ্কিমকে কিভাবে দেখেছেন।
যদুনাথ সরকার রেজাউল করিমকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, " বঙ্কিমের নিকট আমাদের অর্থাৎ মু.সল.মানদের ঋণ অপরিশোধ্য। আজ আমাদের মধ্যে বড় বড় সাহিত্যিক হইয়াছেন মোজাম্মেল হক, ফজলল করীম, এয়াকুব আলী, আব্দুল ওদুদ, নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন। কিন্তু তাঁহারা থাকিতেন কোথায় , ইঁহাদিগকে পাইতাম কোথায় - বঙ্কিম যদি ক্ষেত্র প্রস্তুত করিয়া না রাখিতেন? বঙ্কিমের আজন্ম সাধনার ফল ইঁহারা। "
মনে রাখতে হবে এই প্রবন্ধ লেখা হয়েছে চল্লিশের দশকে, যখন মু.সলি.ম লীগের উস্কানিতে বাংলাভাষী মু.সলি.ম বঙ্কিমকে ব্রাত্য করে রেখেছে। এমনকি গোলাম মোস্তফা প্রমুখ পাকিস্তান সমর্থক বাংলার শিক্ষক যিনি পরবর্তী সময়ে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন।
রেজাউল করিম আরও লিখেছেন, " তিনি তাঁহার জাতির সংজ্ঞায় মু.সল.মানকেও পর্যায়ভুক্ত করিয়াছিলেন। বঙ্গজননীর সপ্তকোটি সন্তানকেই তিনি স্বাধীনতার সংগ্রামে আহ্বান করিয়াছিলেন। সুতরাং বঙ্কিমচন্দ্রকে মু.সলি.ম বিদ্বেষী মনে করিয়া তাঁহার প্রকৃত দানের মর্যাদা ভুলিলে চলিবে না।
বঙ্কিম যদি মু.সল.মান সমাজকে ঘৃণা করিতেন , তবে নবাব আবদুল লতিফ খান বাহাদুর, মোহামেডান লিটারারি সোসাইটির প্রবর্তক কি করিয়া তাঁহার আজীবনের বন্ধু এবং সহচর হইতে পারিলেন? "
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলার কৃষকদের নিয়ে বঙ্কিমের লড়াইয়ের কথা বিস্মৃত হয়েছিলেন, কিন্তু রেজাউল করিম লিখেছেন, " বাঙ্গলায় কৃষকগণের মধ্যে মু.সল.মান ধর্মাবলম্বী শতকরা ৭০ হইবে। এই কৃষক সমাজের ভালর জন্য বঙ্কিম যে লেখনীযুদ্ধ চালাইয়াছেন, তাহা অনেকেই জানে না। "
এবার আসা যাক বন্দেমাতরম প্রসঙ্গে , যেটাকে সুনীল বঙ্কিমের পরিণত বয়সের " ঝোঁকের মাথার " কীর্তি বলেছেন। রেজাউল করিম বলেছেন " আসমুদ্র হিমাচল প্রকম্পিত করিয়াছে অমর বঙ্কিমচন্দ্রের একটি মাত্র সঙ্গীত - বন্দেমাতরম। "
রেজাউল করিম মু.সলি.ম লীগের উস্কানি অগ্রাহ্য করে বলে চলেন " এই বন্দেমাতরম সঙ্গীত মু.সল.মান বিদ্বেষী ও পৌত্তলিক পরিপোষক বলিয়া যে একটা ধূয়া বাঙ্গলা, পাঞ্জাব এমনকি হায়দরাবাদ পর্যন্ত ছড়াইয়াছে ,তাহা অতি সরল বিশ্লেষণ দ্বারা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং অজ্ঞ গোঁড়ামীর ফল বলিয়া প্রমাণ করা হইয়াছে। "
রেজাউল করিম কলম ধরেছিলেন মু.সলি.ম লীগের প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে, কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় প্রগতিশীল সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য আর মু.সলি.ম লীগের প্রোপাগান্ডার কি আশ্চর্য মিল!
এবার আসা যাক " বন্দেমাতরম " সঙ্গীতের শেষের অংশটুকু সম্পর্কে, যেটা সুনীলের মতে সবচেয়ে আপত্তিজনক। রেজাউল করিম বলছেন, " তাহার পর এ সঙ্গীতের শেষ কয়েকটি কলির কথা। ইহা পৌত্তলিকতার জয়সূচক বাণী নহে। এবং ইহা প্রকারান্তরে হি.ন্দু.র দেবদেবীর প্রতি ব্যঙ্গের ইঙ্গিত। হি.ন্দু.রা যে দুর্গা ,কমলা এবং বাণী দেবীর পূজা করেন, এই সঙ্গীতে বলা হইয়াছে , তদপেক্ষাও বড় হইতেছে দেশমাতা। দেশই আমার দুর্গা, দেশই আমার লক্ষ্মী, দেশই আমার সরস্বতী। উহারা আমার নিকট কিছুই নয়, দেশই আমার নিকট সব- সব সাধনার শ্রেষ্ঠ ধন। "
যে আনন্দমঠ সম্পর্কে সুনীলের মন্তব্য , " এই গ্রন্থের মূল বক্তব্য মু.সল.মানেরা হি.ন্দু.দের শত্রু। " , রেজাউল করিম সেই গ্রন্থ সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন, " আনন্দমঠ শুধু আনন্দ দেয় নাই, দিয়াছে প্রাণ, দিয়াছে উৎসাহ, প্রাণে জাগাইয়া দিয়াছে দেশাত্মবোধের মহান আদর্শ। আনন্দমঠ না থাকিলে , পরবর্তী যুগের কোন আন্দোলন ( স্বদেশী, হোমরুল, খেলাফত, অসহযোগ ) সার্থক ও পূর্ণ হইত না। "
বস্তুত বঙ্কিম সাম্প্রদায়িক, এটি মু.সলি.ম লীগ এবং কমিউনিস্টদের যৌথ প্রোপাগান্ডা। সুনীলের মত সাহিত্যিক ওপার বাংলা থেকে এপারে চলে আসতে বাধ্য হলেও দেশভাগের মূল কারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন। বরং বঙ্কিমের ওপর এর দায় চাপিয়ে দেওয়ার অন্যায়টি করেছিলেন, জেনেশুনেই।
তবে মজার ব্যাপার,এত করেও শেষরক্ষা হয়নি। সম্প্রতি ই.সলা.মিক বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাস থেকে শুধু " সাম্প্রদায়িক " বঙ্কিমচন্দ্রই বাদ যাননি,বাদ পড়তে হয়েছে " প্রগতিশীল " ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও।