একে একে সব ঘর চলে গেলেও শুভাশিষ মন্ডলরা এখনো রয়ে গেছে | Bengal Hindus
মন্ডলদের একঘর এখনো রয়ে গেছে। মন্ডলপাড়ার একমাত্র মন্দিরটি তাদের তত্ত্ববধানেই আছে। পুরো মহল্লাটাই ছিলো মন্ডলদের। একে একে সব ঘর চলে গেলেও শুভাশিষ মন্ডলরা এখনো রয়ে গেছে। শুভাশিষ বাইশ বছরের সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া তেজি যুবক। দেশপ্রেমিক। স্বাধীনতা দিবস বিজয় দিবস তো বটেই ৭ মার্চ তাদের বাসা থেকে উচ্চস্বরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজবেই। ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করেছি’ ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা’ এই গানগুলি বছরে দুই তিনবার শুভাশিষ বাজাবেই সেই ছোটবেলা থেকে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অল্প বয়স থেকেই সে পাড়ায় তর্ক বিতর্ক করে আসছে। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিকে মুখের উপর রাজাকার বলতে তার কোন ভয়ডর নেই। মুখের উপর কত মুরব্বীকে সে বলে দিয়েছে, আপনে তো চাচা রাজাকারের মত কথা কইতাছেন!
কলেজে যারার পর শুভাশিষ ছাত্রলীগে নাম লেখায়। তার বসার ঘরে বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনার একাধিক ফটো টাঙ্গানো। শুভাশিষদের স্থানীয় বাজারে কাপড়ের ব্যবসা। মন্ডলদের সেই দিন আর নেই। তবু ব্যবসা করে শুভাশিষের বাবা দিনু মন্ডল মোটামুটি স্বচ্ছলই বলা যায়। তাই শুভাশিষ রাজনীতি পড়াশোনা নিয়ে মেতে থাকতে কোন বেগ পেতে হয়নি। দিনু মন্ডলও তীব্রভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি অনুরক্ত। এখনো মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গেলে, শেখ সাহেবের কথা বলতে গেলে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। ছেলে ছাত্র রাজনীতিতে নাম লেখালে তাই তিনি দ্বিমত করেননি। কিন্তু শুভাশিষের মা ছায়া মন্ডল ছেলের রাজনীতিতে যোগ দেওয়াটা মেনে নিতে পারেনি। তার কেবল ভয় কখন কি হয়ে যায়! একটাই ছেলে তার। সেই ছেলে যদি যেচে মানুষকে শত্রু বানায় তাহলে তিনি স্বস্তিতে ঘরে থাকেন কি করে? খেতে বসে তাই ছেলেকে তিনি বুঝান, বাবা, কে রাজাকার কে ভালোমানুষ এগুলি নিয়ে আমরা কি করব? তুমি যে সবাইকে এসব বলে বেড়াও তাতে যে তোমার শত্রু বাড়তাছে সেটা বুঝো না?
শিভাশিষ মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে বলে, বলো কি মা, রাজাকারকে রাজাকার বলমু না তো কি বলমু?
মা মনে মনে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে, তাতে আমাগো কি লাভ?
ছেলে মার স্বার্থপরতায় বিরক্ত হয়ে বলে, দেখো মা, এই দেশটা আমার। যারা এই দেশটা চায় নাই তাদের ভয়ে আমি কথা বলা বন্ধ করমু এইটা তুমি আশা কইরো না।
অন্যান্য পোষ্টঃ
ছেলেকে বলে আর লাভ নেই জেনে মা তাও শেষে বলে, দেখ বাবা, এগুলি সব রাজনীতি। ক্ষমতায় যাবার জন্য রাতকে দিন, দিনকে রাত সবাই করছে। মাঝখান দিয়া তুমি আমি সাধারণ মানুষ অন্যের চোখে শত্রু হইতাছি। তুমি আমার একটাই সন্তান, তুমি সেটা বুঝো? আমরা হিন্দু মানুষ বাবা, এইটা মাথায় রাইখো।
এই কথাটা শুনলেই শুভাশিষের মাথায় রক্ত উঠে যায়। সে ভাতের থালা ঠেলে সরিয়ে উঠে গেলো রেগেমেগে। বন্ধুদের অনেকেই যখন তার সামনে ‘আমরা হিন্দু মানুষ’ বলে নিজেদের ভীতু সতর্ক হাত কচলে তোষমোদকারী হওয়ার কৌশল নিয়ে এদেশে বাঁচার ইঙ্গিত দেয় তখন শুভাশিষ দুকথা শুনাতে ছাড়ে না। বন্ধুদের সে বলে, যা, ইন্ডিয়া যা গিয়া! এক পা তো দিয়াই রাখছত! দেখমু ইন্ডিয়া গিয়া কেমুন থাকছ।
শুভাশিষের ফেইসবুক জুড়ে দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে প্রোফাইল সাজানো। রাজাকারদের নিয়ে মকারী। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কঠর অবস্থান। সেক্যুলার বাংলাদেশ, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের প্রতি তার কঠর অবস্থান ফেবসবুকের পোস্টগুলি থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে। শুভাশিষদের শত্রু কম নয়। তার ফেইসবুক পোস্টগুলি তারা ফলো করে। শুভাশিষের কখনোই মনে হয়নি সেক্যুলার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে ফেইসবুকে পোস্ট করে তাকে দুবার ভাবতে হবে।
শুভাশিষদের জায়গা জমি নিয়ে অনেকদিন থেকেই একটা ঝামেলা চলছিলো। মাসে মাসে মামলা চালাতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রতি মাসে ডে পড়ে আর তার গুচ্ছে টাকা খরচ। বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে। দিনু মন্ডলের বসবাড়ির দেয়াল ভেঙ্গে উঠোনের অনেকখানি দাবী করে আছে আফজাল শেখ। তার বাবা নাকি এই জমি দিনু মন্ডলের ঠাকুরদার কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে। এরকম ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে মামলা ঠুকে দিয়ে বছরের পর বছর ধরে মামলা চালিয়ে শুভাশিষের বাবার আর্থিক মানসিক উভয়ভাবে দুর্বল করে ফেলা গেছে। আফজাল শেখের টাকার অভাব নেই। সোয়াবিন মিল, গার্মেন্ট কারখানা আছে তার। আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিশনার হিসেবে রাজনৈতিক প্রতিপত্তিও আছে। দিনু মন্ডলের সঙ্গে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধো সংসদ, প্রবীণ এক আওয়ামী লীগের নেতা মিলে আফজাল শেখের সঙ্গে বহুবার বসে কথা বলে মিটমাট করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু মন্ডলবাড়ির উপর তার নজর সরানো যায়নি।
শুভাশিষের কিছু বন্ধু তাকে ঠাট্টা করে যখন এই প্রসঙ্গটা তুলে তখন শুভাশিষ তার সেই সব হিন্দু বন্ধুদের হিন্দুত্ববাদী গরুর বাচ্চা বলে গালি দেয়! বলে যা শালারা, মুদির দেশে গিয়া থাক...। শুভাশিষের কথা, এই দেশে কি মুসলমান মুসলমানের জমি দখল করে না? কোন দেশ নাই সবল দুর্বলকে ঠকানোর চেষ্টা করে না? বরং এগুলি ইন্ডিয়াতে বেশি হয়। ওখানে মুসলমানদের উপর হিন্দুরা অনেক জুলুম করে। বাংলাদেশে আমরা শান্তিতে আছি। এখানে কি নাগরিকত্ব আইন করছে সরকার? দেখ গিয়া মোদি নাগরিকত্ব আইন করে মুসলমানদের নিজের দেশের নাগরিত্বই বাতিল করে দিতাছে।
শুভাশিষ বাকপটু। ইদানিং কলেজে ভাষণটাষণ দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে বলে তার গলার তেজ আরো বেড়েছে। কাজেই বন্ধুরা যে তার সঙ্গে কথায় পেড়ে উঠবে না বলাই বাহুল্য।
তবে সম্প্রতি একটা হোঁচট শুভাশিষ খেয়েছে যেটা সে নিজের মনে হজম করে নিয়েছে। তবু একটা ছোট্ট কাঁটা এখনো গলায় বিঁধছে যেন। যেদিন তাদের মন্দিরের দেয়াল কে বা কারা ভেঙ্গে দিলো রাতের আঁধারে সেদিন শুভাশিষ তার নেতা বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করে একটা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মানববন্ধন আয়োজন করার জন্য চেষ্টা করল সেদিন দেখল নেতা বন্ধুরা উশখুশ করছে। তাকে আড়ালে ডেকে ফিসফিস করে কলেজ লীগ সেক্রেটারি বলল, এগুলি করার চিন্তা করিস না। চেপে যা! নিজেদের মধ্যে এগুলি শুরু হলে শক্তি ক্ষয় হবে।
নিজেদের মধ্যে মানে? শুভাশিষ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল।
কলেজ সেক্রটারি বলল, আরে বাবা সবই তো বুঝোস, আমি বলি তোরা এখনো মিটমাট কেন করতাছোত না? আফজাল ভাই কিন্তু বলছে তিনি বহুতল ভবন করে তোদের নিজ তলায় একটা দোকান দিবে। এমনকি উনি নিচ তলায় আমাদের পার্টির জন্য স্থায়ী একটা অফিসও করে দিবেন।
শুভাশিষ সেদিন খুব দমে গিয়েছিলো। বাড়িতে এসে বিষন্য মনে সেদিন শুতে গিয়েছিলো। কিন্তু অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘুম আসেনি।
পরদিন এক বন্ধুর ফোন পেয়ে তার ঘুম ভাঙ্গল একটু বেলা করে। ওপাড় থেকে বন্ধু উত্তেজিতভাবে বলল, শুভাশিষ, হেফাজত ইসলামের পেইজে গিয়া দেখ, তোরে নিয়া পোস্ট দিছে। তুই নাকি আলেম ওলামাদের শানে বেয়াদপী করছত। তর বিচার চায় তারা।
শুভাশিষ সদ্য ঘুম থেকে উঠে ভালো মত কিছু বঝুতেই পারল না। সে বাথরুম থেকে ঘুরে এসে অভ্যাস মত ফেইসবুকে ঢুকল। স্কল করতে থাকল টাইম লাইন। চট করে একটা পোস্ট চোখে পড়ল, ‘কুলাঙ্গার শুভাশিষ মন্ডলের ফাঁসি চাই’ সঙ্গে তার ছবি। স্কল করে যত নিচে নামতে থাকল দেখতে পেলে তাকে নিয়ে পোস্টগুলি বহু মানুষ শেয়ার করছে। ‘আলেম ওলামাদের শানে বেয়াদপী করা হিন্দু শুভাশিষ মন্ডলের ফাঁসি চাই। সন্মানিত ওলামা কেরামদের ধর্মব্যবসায়ী, শিশু ধর্ষণকারী ও নবীজির সুন্নত মুবারক নিজেদের শরীরের ধরাণ করে ওলামে কেরামরা যে পোশাক পরিচ্ছিদ পরিধার করেন তাকে জঙ্গি বলে আখ্যা দিয়ে চরম ধৃষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছে হিন্দু যুবক শুভাশিষ মন্ডল তার বিচার না করলে পুরো শহর অচল করে দেয়া হবে।
শুভাশিষ সবচেয়ে বেশি চমকে গেলো এই পোস্টগুলি শেয়ার করছে তাদের কলেজ ছাত্রলীগের অনেক সদস্য যারা দিনের পর দিন তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাজাকার বিরোধী আন্দোলনে থেকেছে। তারা শেয়ার দেয়ার সময় লিখছে, মরার সময় আমার রব আমি ছাত্রলীগ করেছি কিনা জিজ্ঞেস করবে না, জিজ্ঞেস করবে তার বন্ধু ওলী আল্লাহদের আমি হেফাজতে শরিক হয়েছিলাম কিনা।
শুভাশিষ থম মেরে ঘরে বসে রইল।
দুপুরের মধ্যে দ্রুত ঘটনা মোড় নিতে শুরু করল। বাজারে তাদের দোকানে তার খোঁজে সেখানে হামলা হয়েছে। তার বাবা সকলের সামনে দুই হাত জোড় করে বলেছেন, যদি আমার ছেলে কোন অপরাধ করে থাকে আমি নিজে তাকে থানায় দিয়ে আসব। সে যদি ধর্ম নিয়ে কোন খারাপ কথা বলে থাকে আমি তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিবো। আপনারা আমার উপর আস্থা রাখুন। এরপর লোকজন চলে গেলোও জোহরের নামাজের পর একদল লোক হঠাত করে মিছিল করতে করতে এসে শুভাশিষদের দোকানে হামলা চালিয়ে লুটপাট করে আগুন দিয়ে দেয়। শুভাশিষদের বাড়িতে আরেকটা দল এসে তার সন্ধান করে বৃষ্টির মত ঢিল ছুড়তে থাকে। থানায় ফোন দেয়ার পর পুলিশ এসে উত্তেজিত জনতাকে বুঝাতে চেষ্টা করে। জনতা পুলিশের সামনেই বলতে থাকে ইসলামের শত্রু এই হিন্দুকে গ্রেফতার না করলে তারা রাজপথ ছেড়ে যাবে না। পুলিশ আলাপ আলোচনা করে তাদের আশ্বস্ত করে যে অভিযুক্ত শুভাশিষকে তারা গ্রেফতার করবে।
অন্যান্য পোষ্টঃ
পুলিশ শুভাশিষকে গ্রেফতার করে থানা হাজতে নিয়ে আসে। পরদিন তার পদ্মা সেতু উদ্ধোধন অনুষ্ঠানে বন্ধুদের সঙ্গে যাবার কথা ছিলো। সেকথাই সে বসে বসে ভাবছিলো। তাদের দোকান যে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেখবর তখনো সে পায়নি। পুলিশ তার মোবাইল আগেই নিজেদের জিন্মায় নিয়ে নিয়েছিলো। শুভাশিষ এটাও জানতে পারেনি তাকে বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসার পর তাদের বাড়িতেও হামলা হয়েছে। সেই হামলা সর্বদলীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে হয়েছিলো বলে পরে শুভাশিষ জেলে বসে শুনেছিলো। তার উকিল জোগার করতে তার বাবাকে ঘাম ছুটাতে হয়েছিলো। শুভাশিষ তাদের পার্টির লিডার এক উকিলের কাছে তার বাবাকে পাঠিয়েছিলো। উকিল সাহেব মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো। শেষে জ্যোতিরময় বড়ুয়া নামের একজন আইনজীবী শুভাশিষের মামলা লড়তে রাজি হন। দেড় বছর পর শুভাশিষ জামিন পায়। তাকে নিয়ে ফেইসবুকে মানবাধিকার অসাম্প্রদায়িক এক্টিভিস্টরা প্রচার চালায়। শাহবাগে একাধিকার মানববন্ধন হয়। অবশেষে তার জামিন দেয়া হয়। বাড়ি ফেরা অব্দি শুভাশিষের মার ধর্ণা দিয়ে পড়ার মত এক কথা, তুই কোলকাতা যাবি! যদি না যাস আমি এই আজ থিকা না খাইয়া থাকলাম। দেখি আমারে তুই কেমন না খাওয়াই মারোস।
শুভাশিষ সন্ধ্যাবেলা ছাদে গিয়ে একলা কাঁদে। কোলকাতায় তার অনেক স্বজন আছে। কোলকাতা তার কাছে নতুন কিছু নয়। তার মাসি পিসিদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে উপলক্ষ্যে অনেকবার তাকে কোলকাতা যেতে হয়েছে। কিন্তু দেশছেড়ে পাকাপাকিভাবে যাবার কথা ভিন্ন। এটা তো তার মাটি ছেড়ে চলে যাবার মত। এটা তো পরাজিত হয়ে পালিয়ে যাওয়া। শুভাশিষ জানে এতদিন সে এইদেশকে যেভাবে জেনেছে সেটাই সত্য। পরিস্থিতি তাকে যেখানেই ফেলুক এদেশের প্রতি তার ভালোবাসা মিথ্যে হতে পারে না। জেলের মধ্যে একজন দাগী আসামী তাকে হুমকি দিয়ে বলেছিলো, মুসলমানগো বিরুদ্ধে কিছু বললে এই দেশে থাকতে পারবি না। ইন্ডিয়া যাবি গিয়া।
শুভাশিষ মেনে নিয়েছে এটা বাস্তবতা। কিন্তু এটাই তার দেশ। শত বাস্তবতায় যা কখনো মিথ্যে হতে পারে না।
@ সুষুপ্তপাঠক
Share করার অনুরোধ রইলো.........