মধ্যযুগে বাংলায় সূফী এবং তাদের ভূমিকা | Sufis and their role in medieval Bengal
মধ্যযুগে বাংলায় সূফী এবং তাদের ভূমিকা
বাংলায় হিন্দু শাসনের পতন এবং মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটেছিল ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি নামক একজন আফগান সেনাপতির হাত ধরে। সে বাংলা এবং বিহার জয় করেছিল তৎকালীন হিন্দু রাজাদের কাপুরুষতা এবং পারস্পরিক বিভেদকে কাজে লাগিয়ে, সাল ১২০৪। তার অভিযানর লক্ষ্য যে শুধুমাত্র রাজ্য বিজয় ছিলনা সে বিষয়ে ইতিহাস বিশারদ পণ্ডিতগণ একমত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পূর্ব ভারতে তার অভিযানের সময়ই আলিমদের ইসলামী দাওয়াতের কাজ সর্বাধিক সাফল্য অর্জন হয়েছিলো এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে বাংলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। খলজির পূর্বপুরুষেরা ছিল তুর্কীস্তানের অধিবাসী। তথাকথিত জিহাদি এই যোদ্ধা ১১৯৩ সালে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুরোপুরি ধ্বংস করে। তৎকালীন বাংলার রাজা লক্ষণ সেনকে অতর্কিত আক্রমনের মাধ্যমে বাংলা জয় করে। অথচ দুঃখের বিষয় এই যে, বাংলার ইতিহাসে সে একজন বীরের ভূমিকায় আছে (বিশেষত বিভিন্ন শ্রেণীর সমাজ বিজ্ঞান বই ঘাটলে তাই জানা যায়)।
তবে কি আমরা বলতে পারি বাংলায় মুসলিম বিজয় খলজির হাতেই হয়েছিল?
প্রকৃতপক্ষে, বাংলায় মুসলিম বিজয়ের সূচনা ঘটেছিল আরও অনেক পূর্বে, পাল শাসনামলে (৭৫০-১১২০) পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ, সেই সঙ্গে ছিল তৎকালীন সময়ে হিন্দু সমাজের উঁচু শ্রেণীদের ছিল সাধারণ হিন্দুদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং শাস্ত্রের অপব্যাখ্যার প্রবনতা। মূলত সমাজের সামগ্রিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে, উপমহাদেশে ইসলামের প্রচারের মূল লক্ষ্যে সূফীদের আগমন ঘটে বাংলায়।
সূফী-ইজম মিলনের কথা বলে, বলে সম্প্রীতি-শান্তির কথা- এমনটাই শুনে আসছি দীর্ঘসময় থেকে। কিন্তু আদৌতে সূফী কারা বা কীইবা ছিল তাদের ভূমিকা প্রাচীন বাংলায়? এই বিষয়ে বিশদ বিবরণের প্রয়োজন বিদ্যমান। ইতিহাস কখনও সত্য কথা বলে না, ইতিহাস লেখা হয় শাসক ও অভিজাতশ্রেণীর হাত দিয়ে। এই শাসক শ্রেণী তাহাদের বিপক্ষের সকল সত্যকে ইতিহাসের পাতা থেকে ছিঁড়ে ফেলে সেখানে তাহাদের জয়গানের কথাই জুড়ে দেয়। মধ্যযুগ থেকে বাংলা আর সজাতির শাসন পায় নাই, দীর্ঘযুগ অধস্তন হয়েছে বিজাতীয় তুর্কি-আফগান শাসকদের। তাই সঠিক ইতিহাস এখন আর খুঁজে পাওয়া দুস্কর।
সূফীদের আগমন ঘটেছিল প্রধানত ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, তুর্কীস্তান- এই অঞ্চলগুলো থেকে। বাংলার ইতিহাসে প্রথম সূফী সাধকের কথা পাওয়া যায় পাল শাসনামলে, অর্থাৎ বখতিয়ার খলজির আগমনের অনেক পূর্বেই নীরবে-নিভৃতে তারা ইসলামের দাওয়াতি কর্মকাণ্ড চালু করেছিলেন এবং পরবর্তীতে উপমহাদেশে ইসলামের পতাকায় সুবাতাস প্রদানে তাহাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ফলস্বরূপ, এই পরবর্তী মুসলিম শাসকেরাই সূফীদের চরিত্রকে ইতিহাসে লিখে গেছেন মহামানবের ন্যায়, শান্তির পূজারী-তৎকালীন শাসকদের হাত থেকে সাধারণ প্রজারক্ষার মাসিহা। কিন্তু প্রকৃত সত্য এই যে, এই সূফীদের সবারই হাত রঞ্জিত হয়েছিল স্থানীয় রাজাদের, সাধারণ মানুষদের রক্তে। আপনি খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন, সূফীদের আস্তানা ছিল তৎকালীন রাজ্যগুলোর এক প্রান্তে, বা রাজধানী থেকে অনেক দূরে। সাধারণ মানুষ বলে থাকবেন, বা ইতিহাস আপনাকে জানাবে- এই জ্ঞানীগণ সব সময় জিকির-ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন, তাই জন-কোলাহল থেকে দূরে থাকার এই ব্যবস্থা। কিন্তু আপনি যদি প্রতিটি সূফীর জীবনী ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে গভীর দৃষ্টিপাত করেন তাহলে কিছু সাধারণ কিন্তু গভীর মিল খুঁজে পাবেন। যেমনঃ
১) প্রত্যেক সূফীই ছিলেন অনেক বিদ্বান, বিচক্ষণ এবং জীবনের দীর্ঘ সময় তারা শিক্ষায় অতিবাহিত করেছেন। এমনকি তারা মক্কা এবং অন্যান্য বিখ্যাত ইসলামী শিক্ষালয় থেকে শিক্ষা লাভ করেছিলেন কোরআন হাদিসের ওপরে। আজকের দিনেও অনেক আলেম আছেন যারা এই একই ভাবে শিক্ষা লাভ করেন।
২) তাদের প্রত্যেকের সাথেই তৎকালীন মুসলিম রাজনৈতিক নেতা, সুলতান, প্রভাবশালী ধর্মীয় গুরুদের যোগাযোগ ছিল। বর্তমানেও বিশ্বের বড় বড় আলেমদের সুসম্পর্ক আছে মুসলিম বিশ্বের সাথে।
৩) তারা প্রত্যেকেই যে কোন অঞ্চলে খানকাহ স্থাপনের পূর্বে দীর্ঘদিন ধরে সেই অঞ্চলের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাহারা সেই অঞ্চলেই খানকাহ স্থাপন করেছেন যেখানে এই ধরণের কোন সমস্যা পূর্ব থেকেই বিদ্যমান বা রাজশাসন দুর্নীতি বা ত্রুটিযুক্ত।
৪) প্রথমেই তারা তাদের আগমনের বিষয়ে অবিশ্বাস্য এবং ঐশ্বরিয় কাহিনী প্রচার করতেন (উদাহরণ স্বরূপ, কেউ মাছের পিঠে, কেউ কুমিরের পিঠে বা কচ্ছপ-গজার মাছের পিঠে চড়ে যাতায়াত করেন)। নদীমাতৃক বাংলাদেশের এই অঞ্চলে গল্পগুলো খুব দ্রুতই বিস্তার লাভ করতো।
৫) দ্বিতীয়ত, তারা অত্যাচারিত জনবসতিগুলোকে টার্গেট করতো, আজকের ভাষায় যাকে বলা হয় সাইলেন্ট সেল (যারা ভিতর ভিতর ইতোমধ্যে বোমা হয়ে আছে প্রচলিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ভূমিকায়, শুধুমাত্র একটি স্ফুলিঙ্গের প্রয়োজন তাদের কে বিস্ফরিত করতে)। এই প্রথা আজও বর্তমান আছে, সুইসাইড স্কোয়াডে প্রথমেই কাজে লাগানো হয় সাইলেন্ট সেল দের।
৬) এই মানুষগুলোর দুঃখ দুর্দশা লাঘবের ছুতোয় তারা তাদেরকে দলে ভেড়াতো। প্রতিবাদ করার ভাষা হিসেবে তাদের যুদ্ধশাস্ত্রে দক্ষ করে তুলতো, আর এবিষয়ে এই সূফীদের সমস্যা হতো না কারণ তাদের সঙ্গে প্রায়ই মুসলিম সুলতানদের সখ্য থাকতো। লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন, আজকের বিভিন্ন আঞ্চলিক ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোও একই কর্ম-পরিকল্পনায় চলছে যা মধ্যযুগে সূফী সাধকেরা করে গেছেন। প্রথমে সমস্যা কবলিত এলাকা সিলেকশন, সাধারণ মানুষদের ব্রেন ওয়াশের মাধ্যমে দলে ভেড়ানো আর প্রশিক্ষন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বা সিরিয়া-জর্ডানের বিভিন্ন রিফুজি ক্যাম্পেও একই ভাবে বিভিন্ন ইসলামিক এন,জি,ও সদস্য সংগ্রহ করে সহায়তার নাম করে।
৭) সূফীগণ যখনই যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করে ফেলতেন, প্রথমেই তারা এমন একটা গুজব ছড়িয়ে দিতেন যাতা তার অনুচররা জীবন দিতেও কুন্ঠা বোধ করবে না, সঙ্গে তাদের সব ধরণের মগজধোলায়। আমি বাংলাদেশের যত মাজার ঘুরেছি, সব খানেই একটা কমন গল্প শুনেছি- অমুক নামে একজন মুসলিম কৃষক ছিল, ছেলের আকিকার জন্য একটা গরু জবাহ করেছিল। তাই শুনে হিন্দু রাজা রেগে তার দুই হাত কেটে দিয়েছে, ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে। সেই অমুক মুসলমান তখন পীর/সূফীর কাছে বিচার চেয়েছে। আর সূফী বাবা এই জন্য রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। একজন মুসলমানকে উত্তেজিত করার জন্য এই একটি গল্পই যথেষ্ট। ভাগ্যক্রমে সেদিন ছাফা খানার চল ছিল না, নইলে কোরআন পোড়ানো বা ছেঁড়ার গল্পটাও সূফীগণ সহজেই ব্যহার করে তার অনুগামীদের উত্তেজিত করতে পারতেন, এতো কষ্ট করে গল্প ফেলতে হতো না- কী অমুক রাজা কোরানে আগুন ধরিয়েছে! আর এতো শত বছর পরেও কিন্তু একই ধরণের পরিকল্পনায় ইসলামিকে দেশ গুলোতে সেনাবাহিনীদের ট্রেনিং দেয়া হয়, বা দাঙ্গা-যুদ্ধ তৈরি করা হয়।
৮) যুদ্ধে মুজাহিদিন-জিহাদিদের জয়, স্থানীয় রাজার যুদ্ধে মৃত্যু বা সপরিবারে ইসলামের আদর্শে/ সূফীর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল। রাজার মৃত্যু হলে রানী/রাজকন্যার প্রাণ ত্যাগ আগুনে/জলে ঝাপ দিয়ে বা সূফী বাবার কোন শিষ্যের যৌনদাসী, ভাগ্য শুভ হলে বিবির মর্যাদা। ইসলামে যুদ্ধ জয়ে অর্জিত সকল সম্পদ হয় বিজিতের এবং একে নাম দেয়া হয় গণিমতের মাল। আই,এস এর ইয়াজিদি মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি, বা ৭১’র যুদ্ধে হিন্দু নারীদের ধর্ষণ, সম্পদ লুটতরাজ একই মুদ্রার বিপরীত পাশ।
৯) যেহেতু সূফীবাবা সংসার ত্যাগী, তাই তিনিতো আর রাজা হতে পারেন না, পাছে লোকে কি বলবে। তাই তার নির্ধারিত কেউ সুলতান হয়ে ইসলামের বিজয়কে চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে থাকে। এইবার জনসাধারণের যারা ইসলাম কবুল করবে তাদের সমস্যা নেই, যারা কবুল করতে নারাজ তাদের ওপরেই নেমে আসতো খড়গ। ইতিহাসের পাতায় পাতায় মধ্যযুগীয় বর্বরতার এই সাক্ষর আছে, যা অনেক চেষ্টার পরেও ঢাকা যায় নাই।
১০) সব শেষ কাজ, ইতিহাসের পাতা থেকে সুফী বাবার সব কুকৃতি মুছে ফেলা এবং তাকে মানব থেকে অতি-মানবে পরিণত করার জন্য নতুন ইতিহাস লেখা। আর এই ইতিহাসই আজ আপনি-আমি পরছি। সুফিরা শান্তির দূত, শান্তির বার্তা প্রচার করেছেন। আজ থেকে শত বর্ষ পরে ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীর নেতারাও একই ভাবে বন্দিত হবে, সে বিষয়ে আমি একমত। তারাও কথিত হবেন একেকজন সূফী সাধক নামে, যারা সাধারণ মানুষদের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করে গেছেন।
সূফীদের কর্মপরিকল্পনা এবং বিভিন্ন ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর কর্মপরিকল্পনা পাশাপাশি চার্ট আকারে দেখানো হলঃ
নিচে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন সুফী সাধকদের নাম, তাদের ভূমিকা তুলে ধরা হলঃ
মাজার একটি আরবি শব্দ, সমার্থক শব্দ দরগাহ। ইসলামে মাজার শব্দটি ব্যবহার করা হয় তীর্থস্থান হিসেবে। ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, বিভিন্ন সময় হিন্দুগণও বিভিন্ন মাজার ভ্রমণ করেন তীর্থভ্রমনের ন্যায়। তাহারা সেখানে মনস্কামনা পূরনের লক্ষ্যে মানত করেন, সুফী বাবার দরবারে কান্নাকাটি করেন, সিন্নি-ভোগ আর চাদর চড়ান। হিন্দুদের যেকোন পুরাতন বস্তুর ওপরে যে সহজেই ভক্তি জন্মায় তা ইহাতেই প্রমাণিত হয়। কিন্তু ভক্তির পেছিনের গল্পটুকুও তো জানা প্রয়োজন। দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য, একথা আমরা অনেক বারই পরেছি আর এইখানে এই দুর্জন তো আপনার শত্রু। একদিন আপনারই পূর্বপুরুষদের ছলে-বলে-কৌশলে ধংসের পেছনে এই সূফী সাধকেরাই ছিল এবং আপনার উত্তর পুরুষের অস্তিত্ব বিপন্নের পেছনেও তাহারাই থাকবেন।
সাধারণ মানুষদের পাশাপাশি ভারতের বলিউড সেলিব্রেটি, রাজনৈতিক নেতাদেরও বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় আজমির শরীফে খাজা মইনুদ্দিন চিশতী সহ বিভিন্ন স্থানে সূফীদের মাজার পরিদর্শন করে সিন্নি চড়াতে। ১২ আউলিয়ার দেশ চট্টগ্রাম, ৩৬০ আউলিয়ার দেশ সিলেট- আরও কতো হাজার আউলিয়া শুয়ে রয়েছেন এই বাংলার মাটির তলায়। বাংলার প্রতি গ্রামে, প্রতি শহরে এমন নাম না জানা শত শত মাজার-দরগাহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেই সব আউলিয়াদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলায় ইসলামের সুপ্রতিষ্ঠা। তারা সফল, আথচ আজও আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষগুলো নিজেদের রক্তাক্ত ইতিহাস না জেনেই সেই সব মাজারে-দরগায় ভক্তি নিয়ে ভোগ চরান।
তথ্যপূর্ন লেখাটি উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ লেখককে। এছাড়া ধন্যবাদ এই ওয়েবসাইটকে।