যিনি জীবকে মুক্ত করেন, তিনিই মায়ায় বাঁধেন - Shri Kushal Baran Chakraborty
![]() |
| মহামায়া |
আদ্যাশক্তি মহামায়া অরূপ, অনন্ত এবং অচিন্ত্য। তিনি ত্রিগুণের অতীত। তাঁর কোন নিদিষ্ট মূর্তি নেই। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই তাঁর প্রকাশ। এরপরেও সন্তানের রক্ষার্থে এবং আসুরিক শক্তির বিনাশে বিভিন্নভাবে বিভিন্নরূপে যুগেযুগে তিনি আবির্ভূত হন। প্রয়োজনে আবির্ভূত হওয়া ক্ষণিকের সেই রূপকেই ঋষি, মুনি, ভক্তরা ধ্যানমন্ত্রে লিপিবদ্ধ করেন।সে ধ্যানমন্ত্রকে অনুসরণ করেই সাধকেরা অচিন্ত্য আদ্যাশক্তি মহামায়ার সাধনপথে অগ্রসর হয়। শ্রীচণ্ডী, দেবীভাগবত, মহাভাগবতসহ একাধিক স্থানেই বলা আছে, সেই মহাদেবীর কোন রূপ নেই এরপরেও নিরাকার সেই মহাশক্তিই লীলার জন্য জগতে দেহ ধারণ করে আবির্ভূত হন। তাঁর জগতে অবতীর্ণের প্রধান কাজই হল, দুষ্টের বিনাশ এবং সাধুদের পরিত্রাণ।
জগতের প্রধানতম তিনটি কর্ম হল সৃষ্টি, পালন এবং প্রলয়। সে অনুসারে আদ্যাশক্তি মহামায়ারও তিনটি প্রধান রূপ। তিনিই জগতকে মোহিত করে রেখেছেন, আবার তিনিই প্রসন্ন হয়ে জগতের বন্ধন ছিন্ন করে মুক্তি প্রদান করছেন।এই মহামায়াই জগতের পালন শক্তি বিষ্ণুর যোগনিদ্রারূপা তমঃপ্রধানা শক্তি।এ অচিন্ত্য শক্তিতে আদ্যাশক্তি মহামায়াই মনুষ্য সহ জগতের সকল জীবকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছেন। তিনি বিবেকিগণেরও চিত্তসমূহ বলপূর্বক আকর্ষণ করে মোহাবৃত করছেন।
বিষয়টি শ্রীচণ্ডীর প্রথম চরিত্রে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। তাঁর শক্তিতেই এ জগত ক্রিয়াশীল এবং অস্তিত্বশীল। তাঁর শক্তি না থাকলে শিব শবরূপ হয়ে তাঁর পদতলে লুটায়।
ঋষিরুবাচ। ৪৬
জ্ঞানমস্তি সমস্তস্য জন্তোর্বিষয়গোচরে । ৪৭
বিষয়শ্চ মহাভাগ যাতি চৈবং পৃথক পৃথক্ ॥
দিবান্ধাঃ প্রাণিনঃ কেচিদ্রাত্রাবন্ধাস্তথাপরে । ৪৮
কেচিদ্দিবা তথা রাত্রৌ প্ৰাণিনস্তল্যদৃষ্টয়ঃ ॥
জ্ঞানিনো মনুজাঃ সত্যং কিন্তু তে ন হি কেবলম্ । ৪৯
যতো হি জ্ঞানিনঃ সর্বে পশুপক্ষিমৃগাদয়ঃ ॥
জ্ঞানঞ্চ তন্মনুষ্যাণাং যত্তেষাং মৃগপক্ষিণাম্ । ৫০
মনুষ্যাণাঞ্চ যত্তেষাং তুল্যমন্যৎ তথোভয়োঃ ॥
জ্ঞানেঽপি সতি পশ্যৈতান্ পতগাঞ্ছাবচঞ্চুষু । ৫১
কণমোক্ষাদৃতান্ মোহাৎ পীড়্যমানানপি ক্ষুধা ॥
মানুষা মনুজব্যাঘ্র সাভিলাষাঃ সুতান্ প্রতি। ৫২
লোভাৎ প্রত্যুপকারায় নম্বেত কিং ন পশ্যসি ॥
তথাপি মমতাবর্তে মোহগর্তে নিপাতিতাঃ । ৫৩
মহামায়াপ্রভাবেণ সংসারস্থিতিকারিণা ॥
তন্নাত্র বিস্ময়ঃ কার্যো যোগনিদ্রা জগৎপতেঃ। ৫৪
মহামায়া হরেশ্চৈতত্তয়া সংমোহ্যতে জগৎ ॥
জ্ঞানিনামপি চেতাংসি দেবী ভগবতী হি সা । ৫৫
বলাদাকৃষ্য মোহায় মহামায়া প্ৰযচ্ছতি ॥
তয়া বিসৃজ্যতে বিশ্বং জগদেতচ্চরাচরম্' । ৫৬
সৈষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে ॥
সা বিদ্যা পরমা মুক্তেৰ্হেতুভূতা সনাতনী ।৫৭
সংসাবন্ধহেতুশ্চ সৈব সর্বেশ্বরেশ্বরী ॥ ৫৮
(শ্রীচণ্ডী:১. ৪৬-৫৮)
"মেধা ঋষি বললেন-হে মহামতে, সমস্ত প্রাণীরই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপরসাদি বিষয়ে জ্ঞান রয়েছে। বিষয়সমূহ এইরূপে পৃথগভাবে তাদের জ্ঞানগোচর হয়। পেচকাদি কোন কোন প্রাণী দিবসে দৃষ্টিশক্তিহীন; কাক প্রভৃতি অন্যান্য প্রাণী আবার রাত্রিতে অন্ধ। কেঁচো প্রভৃতি কোন কোন প্রাণী দিবা ও রাত্রিতে দৃষ্টিশক্তিহীন এবং বিড়াল সহ কোন কোন প্রাণী দিবা ও রাত্রিতে সমানদৃষ্টিসম্পন্ন। সত্যই মানবগণের বিষয়জ্ঞান আছে। কিন্তু কেবল তারাই বিষয়জ্ঞানবান নহে। কারণ পশু, পক্ষী, মৃগ ইত্যাদি সকল প্রাণীরই বিষয়জ্ঞান আছে। পশুপক্ষিগণের যেমন বিষয়জ্ঞান, মনুষ্যগণেরও তদ্রূপ বিষয়জ্ঞান। আবার মনুষ্যগণেরও যেরূপ বিষয়জ্ঞান, পশু-পক্ষিগণেরও তদ্রূপ। আহার নিদ্রাদি অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞান পশু ও মানুষ উভয়েরই সমান। দেখুন, শাবকের ভোজনে নিজেদের ক্ষুধা নিবৃত্তি হয় না তা জেনেও পক্ষিগণ নিজেরা ক্ষুধায় কাতর হইয়াও মোহবশতঃ শাবকগণের চঞ্চুপুটে শস্যকণাপ্রদান করে। হে নরশ্রেষ্ঠ, আহা!
এই মানবগণ প্রত্যুপকারের লোভে পুত্রাদির প্রতি অনুরক্ত হয়। তা কি দেখছেন না? তথাপি সংসারের স্থিতিকারিণী মহামায়ার প্রভাবে জীবগণ মোহরূপ গর্তে ও মমতারূপ আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়। এই মহামায়াই জগৎপতি বিষ্ণুর যোগনিদ্রারূপা তমঃপ্রধানা শক্তি।এই শক্তি জগতের সকল জীবকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছেন। অতএব এ বিষয়ে বিস্মিত হওয়া উচিত নয়। দেবী ভগবতী মহামায়া বিবেকিগণেরও চিত্তসমূহ বলপূর্বক আকর্ষণ করে মোহাবৃত করছেন। সেই মহামায়া এই সমগ্র চরাচর জগৎ সৃষ্টি করেন। তিনি প্রসন্না হলে মানুষকে মুক্তিলাভের জন্য অভীষ্ট বর প্রদান করেন। তিনি সংসার মুক্তির হেতুভূতা পরমা ব্রহ্মবিদ্যারূপিণী ও সনাতনী। তিনিই সংসারবন্ধনের কারণস্বরূপা অবিদ্যা এবং সকলের ঈশ্বরী।"
আদ্যাশক্তি মহামায়ার শক্তিতে জগতের সকল জীব মোহিত। এই নারী পুরষের পারস্পরিক আকর্ষণ থেকে শুরু করে সন্তানের সাথে পিতামাতার স্নেহ এ সকলই অচিন্ত্য আদ্যাশক্তির প্রভাবে। তাই তাঁর নাম মহামায়া।পশুপাখিদের মধ্যেও তাঁর শক্তির প্রভাব ক্রিয়াশীল। সন্তানের ভোজনে নিজেদের ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না— এ বিষয়টি জেনে মানুষ তো বটেই পশুপাখি পর্যন্ত সন্তানের প্রতি স্নেহবশত নিজের খাবার সন্তানের মুখে তুলে দেয়। পরিণামে সে ক্ষুধায় কাতর হয়েও ক্ষুধার্ত থেকে সন্তানের সন্তুষ্টি দেখে সন্তুষ্ট হয়। সংসারের স্থিতিকারিণী মহামায়ার প্রভাবে জীবগণ মোহ এবং মমতারূপ আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে জন্মজন্মান্তরের আবর্তে ঘুরতে থাকে।মধ্যযুগের শাক্তপদাবলীতে শাক্তকবি রামপ্রসাদ সেন অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় মহামায়ার কাছে তাঁর মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি চেয়েছেন।
ভ্রমর যেমন পদ্মফুলের মধুর লোভে পদ্মে আকৃষ্ট হয়। তেমনি সংসারে মায়াবদ্ধ জীব পদ্মের চিত্রকে পদ্ম মনে করে, সেই চিত্রের পদ্মতে মধুপান করতে গিয়ে সারাদিনরাত্রি বসে থাকে। ভাবে এই বুঝি মুখে মধু পাবে। কিন্তু সে আশায় আশায় বসে থেকে প্রতারিত হয়। তাই রামপ্রসাদ সেন জগন্মাতাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, "কোলের ছেলে, ঘরে নিয়ে চলো"। অর্থাৎ জগন্মাতার যে কোল থেকে এসেছেন, তিনি যেন তাঁর সেই কোলেই আবার ফিরে যেতে পারেন। এ সংসারের ভোগকে চিনির মত মিঠা মনে করেছেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে দেখলেন এ সংসারের আসক্তি চিনির মত মিঠা নয়, নিমের মত তিতা। সেই মিঠা খেতে গিয়ে, খেলেন নিমতিতা। সংসারের জাগতিক ভোগগুলো এমনিই হয়। মানুষ ভাবে একপ্রকার, হয় অন্যপ্রকারের। সাধক রামপ্রসাদের তাই ভোগের আশার মরু মরীচিকার সাধ মিটে গেছে। জীবন সায়াহ্নে তিনি তাই মায়ার সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মায়ের কোলে ফিরে যেতে চান। সেখানেই অনন্ত শান্তি, অনন্ত আনন্দ এবং অনন্ত আলোকদীপ্তি।
"কেবল আসার আশা, ভবে আসা, আসা মাত্র হল ।
যেমন চিত্রের পদ্মেতে পড়ে, ভ্রমর ভুলে রল ॥
মা নিম খাওয়ালে , চিনি বলে, কথায় করে ছল ।
ওমা ! মিঠার লোভে,
তিত মুখে সারা দিনটা গেল ॥
মা খেলবি বলে, ফাঁকি দিয়ে নাবালে ভূতল ।
এবার যে খেলা খেলালে মাগো,
আশা না পুরিল ॥
রামপ্রসাদ বলে ভবের খেলায়,
যা হবার তাই হল ।
এখন সন্ধ্যাবেলায় কোলের ছেলে,
ঘরে নিয়ে চলো ॥"
সাধক রামপ্রসাদের জগন্মাতার যে কোল থেকে এসেছেন, সেই কোলেই আবার ফিরে যাওয়ার ভাবটি কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংগীতেও দৃঢ়ভাবে রয়েছে। তাঁর 'রাঙা জবা' নামক শ্যামাসংগীতের গ্রন্থের একাধিক সংগীতে এ ভাবটি রয়েছে। একটি সংগীতে (রাঙা জবা: ৩১) তিনি বলেছেন, জীবনের সংসার নামক অপূর্ণতার পুতল খেলায় তিনি আজ বড় ক্লান্ত। যে মোহমায়ার প্রভাবে মন ভুলানো পুতুল খেলায় তিনি এতদিন মগ্ন ছিলেন; সেই পুতুলের অর্ধেক হারিয়ে গেছে এবং অর্ধেক ভেঙে কোনমতে হাতে পড়ে রয়েছে। এরমধ্যেই জীবনের সন্ধ্যাকাল চলে এসেছে।জীবনের সন্ধ্যাকালে চারিদিকে আঁধার হয়ে আসছে, সে আঁধার বড় কালো। তাই কবি জগন্মাতাকে আহ্বান করছেন, তাকে খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে না রেখে, কোলে তুলে নিতে। কোলে তুলে আঁচল ডেকে ছোট্ট শিশুটির মত ঘুম পাড়িয়ে দিতে।
"কোথায় গেলি মা গো আমার
খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রেখে।
ক্লান্ত আমি খেলে খেলে
এ সংসারের ধূলি মেখে ৷৷
বলেছিলি সন্ধ্যা হলে
ধূলি মুছে নিবি কোলে,
(ও মা) ছেলেরে তুই গেলি ছলে-
(এখন) পাই না সাড়া ডেকে ডেকে৷।
একি খেলার পুতুল মা গো
দিয়েছিলি মন ভুলাতে,
আধেক তাহার হারিয়ে গেছে
আধেক ভেঙে আছে হাতে।
এ পুতুলও লাগছে মা ভার,
তোর পুতুল তুই নে মা এবার
(এখন) সন্ধ্যা হল, নামল আঁধার,
ঘুম পাড়া মা আঁচল ঢেকে ৷৷"
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
