হিন্দুরা কেন দেশত্যাগ করেন? | Why do Hindus emigrate? | Bangladeshi Hindus
এদেশের হিন্দুদের দেশপ্রেম নেই তারা মূলত ভারত প্রেমি তাই তারা ভারতে চলে যায়। বড় একটি অভিযোগ হলো, হিন্দুরা এদেশে মুসলিমদের চেয়েও বেশি সুফল ভোগ করে এবং দেশের টাকা ভারতে প্রাচার করে। ভয়ংকর কথা হচ্ছে এটি এদেশের ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে ৯৯ ভাগ মুসলমানই বিশ্বাস করেন। কাজেই বুঝতে সক্ষম হওয়ার কথা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের চোখে হিন্দু সম্প্রদায় কতখানি ঘৃণা আর অবিশ্বাসের শিকার। এর মধ্যে কিছু সুবিধাভোগী হিন্দু, নাম গোপন করা নওমুসলিম হিন্দু এই হাওয়ায় জোর তাল দিয়ে পরিস্থিতি আরো কঠিন করে তুলছে। আসুন দেখা যাক বাস্তব চিত্রটি আসলে কি।
১৯৪৭ সালের দেশভাগে বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ হিন্দু সম্প্রদায় দেশত্যাগ করেন যাদের সিংহভাগ উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়। বন্দোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, চট্টপাধ্যায় আর চক্রবর্তীরাই ছিল ইংরেজ আমলে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি। অবিভক্ত বাংলায় তারা বুদ্ধিজীবী, জাতির ধারকবাহক, চিন্তা ও মননের কারিগর। Why do Hindus emigrate?
বাঙালী মুসলমান শিক্ষায়দীক্ষায় পিছিয়ে ছিল তার মানে এই না হিন্দু সম্প্রদায় এগিয়েছিল। ঐ যে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় ও কায়স্ত্র সম্প্রদায়, এদের মধ্যেই শিক্ষা ও মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছিল। বাকীরা সাধারণ বাঙালী নিম্নবিত্ত মুসলমানদের মতই অশিক্ষিত আর দরিদ্রই ছিল। ইংরেজদের উপর অভিমান করে মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে নাই- তারা হিন্দুদের থেকে পিছিয়ে ছিল এটা হাস্যকর যুক্তি। মুসলিমদের মধ্যে তখন আরবী-ফারসী ভাষা চর্চা ছিল, কেউ কি দেখাতে পারবে সে সময় বাঙালী মুসলিমরা সে শিক্ষায় বিদ্যার জাহাজ ছিল?
এরা ছিল আকাট মূর্খ আর দরিদ্র। আহমদ শরীফ জানাচ্ছেন, মুখ্যোপাধ্যায় আর বন্দ্যোপাধ্যায়রা ইংরেজ আমলের নিজ উদ্যোগে গ্রামে যে স্কুলগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেখানেই দু-চারজন নিম্নবিত্ত মুসলমান ও নিম্নবর্ণ হিন্দুর সন্তানও লেখাপড়ার সুযোগ পায়। তাদেরই প্রথম প্রজন্ম ছিলেন কাজি মোতাহার হোসনদের প্রজন্ম। কিন্তু বিপুল সংখ্যা অশিক্ষিত গরীব বাঙালী মুসলমানদের নেতা ছিলেন উর্দুভাষী অবাঙালীরা। বাঙালী মুসলমান ধর্মের মিল থাকায় সেই সব উর্দুভাষী অবাঙালীদের হাতে তাদের ভাগ্যের ভার ন্যস্ত করেছিল। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে উর্দুভাষী মুসলমানদের নেতৃত্রে বাঙালী মুসলমান তাদের নিজেদের জন্য ‘মুসলমানদের দেশ’ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
অন্যদিকে শিক্ষিত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা দেশভাগে ভারতে গমন করলে বিপুল সংখ্যাক দরিদ্র অশিক্ষিত হিন্দু নিজেদের গাছতলায় আবিষ্কার করেন। অর্থ্যাৎ, অশিক্ষিত মুসলমানদের জন্য উর্দুভাষী সরোবর্দি থাকলেও নিম্নবর্ণের দরিদ্র অশিক্ষিত হিন্দুদের কেউ রইল না। যদিও একই থাকল তাদের ভাগ্য। আগে যারা তাদের শাসন করত চাট্টুজ্যে আর মুখার্জীরা তাদের বদলে আসল উর্দুভাষী মুসলমানরা। যেহেতু চিরকাল এরা দরিদ্র ও কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্যে ছিল তাই তাদের মানসিক গঠন আগে থেকেই দুর্বল ছিল। দেশভাগ ও ভয়ংকর নোয়াখালি দাঙ্গার মত দগদগে ঘা তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা এনে দিল। তাদের হয়ে কথা বলার মত কেউ ছিল না। দেশভাগে ডামাডলে, নেহেরুদের ক্ষমতা ভাগাভাগি, দেশত্যাগকারী উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিজেরাই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়ছিল কোলকাতার পথে-ঘাটে – কাজেই এইসব পূর্ববঙ্গের চাষাভুষা, নাপিত, জেলে, নমশুদ্র, কিছু কায়েত-বামুনদের কথা কে ভাববে? এইসব মাথায় নিয়েই পাকিস্তানে অবশিষ্ট হিন্দুদের বসবাস শুরু। Why do Hindus emigrate?
‘মুসলিমদের নিজেদের দেশ পাকিস্তানে’ হিন্দুদের জীবন শুরু হলো। ৬৫ সালে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়, পূর্ববঙ্গে শেষ অস্তিত্বশীল প্রতিনিধিশীল শিক্ষিত হিন্দুদের ভিটেবাড়ি এনিমি প্রোপার্টি হিসেবে সরকার গ্রাস করা শুরু করে। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় হিন্দুরা। হাজার হাজার হিন্দু সম্পত্তি মুসলিম লীগের নেতাদের কব্জায় চলে আসে।
আজো সেই ধারা অব্যাহত আছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রথম টার্গেটই ছিল কাফের হিন্দুরা। প্রথম দিকে এই হিন্দুদের উপর নির্যাতন ছিল হিটলারের ইহুদী নিধনের সমতুল্য। বিপুল সংখ্যক হিন্দু তখন দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয় যাদের বেশির ভাগ আর ফেরত আসেনি। অবশিষ্টরা যারা দেশে ছিল তারা দেশ স্বাধীন হবার পর বিগত ৪৪ বছরের নিজেদের শিক্ষায় ও যোগ্যতায় নানাভাবে নিজেদের উচ্চ করতে পারেনি প্রতিকূল পরিবেশে। অস্বীকার করার উপায় নেই, আজকের সময়ে বাঙালী হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ শিক্ষিত ও আর্থিক অবস্থা উন্নতি করতে শুরু করেছে কিন্তু উপরে যে ঐতিহাসিক কারণগুলো বললাম তারই ধারাবাহিকতায় আজো পশ্চাৎপদ মনোভাব তাদের মধ্যে বিদ্যমান। তারা লড়াই করতে রাজি নয়। অভিযোগ করতেও ইচ্ছুক নয়। নিরবে-নিভৃতিতে দেশত্যাগ করতে পারলেই তারা খুশি।
কিন্তু ভারতের মুসলিমদের কথা ভিন্ন। দেশভাগের সময় বাঙালী মুসলমানদের পাকিস্তানে আসার হার খুবই নগন্য। বদরুদ্দিন উমরারের মত শিক্ষিত রাজনৈতিক পরিবাররা এসেছে কিছু। যদিও উমারদের পরিবার উর্দুভাষী ছিলেন। অন্যদিকে দেশভাগের শেষে ভারতে অবাঙালী মুসলমানদের এত বছরেও ভারত ত্যাগের কোন কারণ ঘটেনি অনেকগুলো কারণে। প্রথমত ভারত স্বাধীন হবার পর সেখানে গণতন্ত্র শক্তিশালী অবস্থানে গড়ে উঠে যেটা পাকিস্তান ও বাংলাদেশে আজো হয়নি।
ভারতের বহু রাজ্য মুসলিমরা সংখ্যায় আগে থেকেই শক্তিশালী, বিত্তশালী, তাদের নেতৃত্ব শ্রেণী ভারত স্বাধীনতার শুরু থেকে তাদের সামনে রেখে এগিয়েছে। শেষ কারণটি হলো জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন। ভারতে মুসলিমরা জানে নানা রকম দাঙ্গা বা রাজনৈতিক অস্তিরতা থাকলেও ভারতই তাদের শেষ আশ্রয় স্থল কেননা পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মত দেশে ধর্মীয় পরিচয়ে প্রবেশ করা মাত্রই তাদের জাতি সত্ত্বা পরিচয়টি প্রথম ও একমাত্র হয়ে উঠবে। এই পরিচয়েই শুরু হবে নতুন বৈষম্য, বিদ্বেষ আর দমননীতি। পূর্ববঙ্গে বাঙালী মুসলমান ইতিহাসে এই প্রসঙ্গে একটি বড় উদাহরণ। Why do Hindus emigrate?
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার বই ‘ভারত স্বাধীন হল’ লিখেছেন, পাকিস্তানে যেতে ভারতীয় মুসলমানরা অনিচ্ছুক ছিল কারণ ধর্মীয় পরিচয়ে পাকিস্তানে যাবার পরই তাদের পাঠান, শেখ, পাঞ্জাবী ইত্যাদি পরিচয়গুলো বড় হয়ে উঠবে। কিন্তু ভারতে ‘মুসলমান’ পরিচয়ে তারা অনেক রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ! তাই যারা ভারতের নানা ভাষা ও জাতির বৃহৎ মুসলমনাদের সঙ্গে বাংলাদেশের বাঙালী হিন্দুদের দেশত্যাগের তুলনা করতে চায় তারা মতলববাজ নয়ত ইতিহাস সম্পর্কে এদের কোন ধারনাই নেই।
লিখেছেনঃ Susupto Pathok